দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম
বেদের দেবতা
(বেদশীর্ষক প্রবন্ধের পরভাগ)
আমরা বেদ সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহার উদ্দেশ্য যে কেবল পাঠককে দেখাইব, বেদে কি রকম সামগ্রী আছে, তাহা নহে। আমাদের আর একটি উদ্দেশ্য এই যে, বেদে কোন্ দেবতাদের উপাসনা আছে? ঋগ্বেদসংহিতা বেদের সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন অংশ বলিয়া আধুনিক পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন, তাই, আমরা এখন ঋগ্বেদসংহিতার আলোচনায় প্রবৃত্ত, কিন্তু সময়ে বেদের অন্যান্যাংশের দেবোপাসনার স্থূল মর্ম্ম যাহা পাওয়া যায়, তাহা বুঝাইব। এখন, আমরা দেখিয়াছি, ঋগ্বেদে আছে যে, দেবতা তেত্রিশটি, কবি, ভক্ত বা ঠাকুরাণীদিদিগের গল্প গল্পে তেত্রিশ কোটি হইয়াছে।
তার পর দেখিয়াছি যে, সেই তেত্রিশটি দেবতা, শতপথব্রাহ্মণে (ইহাও বেদ) তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়াছেন, যথা (১) আদিত্য, (২) রুদ্র, (৩) বসু। তার পর মহাভারতে এই তিন শ্রেণীর দেবতার যেরূপ নাম দেওয়া আছে, তাহাও দিয়াছি।
ঋগ্বেদের সঙ্গে ইহার কিছু মিলে না। ইহার মধ্যে কোন কোন দেবতার নামও ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদে এমন অনেক দেবতার নাম পাওয়া যায়, যাহা এই তালিকার ভিতর নাই। ঋগ্বেদে কতকগুলি আদিত্যের নাম আছে বটে, এবং রুদ্র ও বসু শব্দদ্বয় বহুবচনে ব্যবহৃত হইয়াছে। কিন্তু দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, এবং অষ্ট বসু, এমন কথা নাই। ঋগ্বেদে নিম্নলিখিত দেবতাদিগের নাম পাওয়া যায়।
(১) মিত্র, বরুণ, অর্য্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্ত্তণ্ড, সূর্য্য, সবিতা ও ইন্দ্র। ইহাদিগকে ঋগ্বেদের কোন স্থানে না কোন স্থানে আদিত্য বলা হইয়াছে। ইহার মধ্যে অর্য্যমা, ভগ, দক্ষ, অংশ, মার্ত্তণ্ড ইঁহাদিগের কোন প্রাধান্য নাই।
(২) আর কয়টির, অর্থাৎ মিত্র, সূর্য্য, বরুণ, সবিতা ও ইন্দ্রের খুব প্রাধান্য। তদ্ভিন্ন নিম্নলিখিত দেবতারাও ঋগ্বেদসংহিতায় বড় প্রবল।
অগ্নি, বায়ু, মরুদ্গণ, বিষ্ণু, পর্জ্জন্য, পূষা, ত্বষ্টা অশ্বীদ্বয়, সোম।
(৩) বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব আছে।
(৪) ত্রিত, আপ্ত্য, অধিব্রধ্ন ও অজ একপদের নাম স্থানে স্থানে পাওয়া যায়।
(৫) এই কয়টি নামে সৃষ্টিকর্ত্তা বা ঈশ্বর বুঝায়-বিশ্বকর্ম্মা, হিরণ্যগর্ভ, স্কম্ভ, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্ম।
(৬) তদ্ভিন্ন কয়েকটি দেবী আছেন। দুইটি দেবী বড় প্রধানা-অদিতি ও ঊষা।
(৭) সরস্বতী, ইলা, ভারতী, মহী, হোত্রা, বরুত্রী, ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী, বরুণানী, অশ্বিনী, রোদসী, রাকা, সিনিবালী গুঙ্গূ, শ্রদ্ধা ও শ্রী, এই কয় দেবীও আছেন। তদ্ভিন্ন পরিচিতা সকল নদীগণও স্তুত হইয়াছেন।
এক্ষণে, আগে আদিত্যদিগের কথা কিছু বলিব। আদিত্য শব্দে এখন সচরাচর সূর্য্য বুঝায়। দ্বাদশ আদিত্য বলিলে অনেকেই বারটি সূর্য্য বুঝেন। অনেক পণ্ডিত আবার এই ব্যাখ্যা করেন যে, দ্বাদশ আদিত্য অর্থে বারটি মাস বুঝিতে হইবে। পক্ষান্তরে আদিত্য সকল দেবতাদিগের সাধারণ নাম, এরূপ প্রয়োগও আছে। যাঁহারা অমরকোষের ছত্র দুই চারি পড়িয়াছেন, তাঁহারাও জানেন যে, “দেব” ইহার প্রতিশব্দ মধ্যে “আদিতেয়” শব্দটি ধরা হইয়াছে। আদিতেয়, আদিত্য, একই। এরূপ গণ্ডগোল কেন? দেখা যাউক আদিত্য শব্দের প্রকৃত অর্থ কি?