শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
তাহা নহে, ইন্দ্রিয়ের উপভোগ নিষিদ্ধ নহে, তাহার বিশেষ বিধি পরশ্লোকে দেওয়া হইতেছে।
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রয়ৈশহচরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি || ৬৪ ||
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি || ৬৪ ||
যিনি বিধেয়াত্মা, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত এবং আপনার বশ্য ইন্দ্রিয়গণের দ্বারা বিষয়ের উপভোগ করিয়া প্রসাদ লাভ করেন।৬৪।
বিধেয়াত্মা-যাঁহার আত্মা বা অন্তঃকরণ বশবর্ত্তী।
ঈদৃশ ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সকল নিজের আজ্ঞাধীন-বলের দ্বারা তাঁহার চিত্ত হরণ করিতে পারে না। তাঁহার ইন্দ্রিয়সকল ভোগ্য বিষয়ের প্রতি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত-ইন্দ্রিয়সকল তাঁহার বশ, তিনি ইন্দ্রিয়ের বশ নহেন। ঈদৃশ ব্যক্তি ইন্দ্রিয়াদি বিষয়ের উপভোগ করিয়া প্রসাদ বা শান্তি 65 লাভ করেন। অর্থাৎ তাঁহার কৃত উপভোগ দুঃখের কারণ নহে, সুখের কারণ। তাই বলিতেছিলাম যে, গীতোক্ত এই ধর্ম্ম Ascetic Philosophy নহে-প্রকৃত পুণ্যময় ও সুখময় ধর্ম্ম। বিষয়ের উপভোগ ইহাতে নিষিদ্ধ হইতেছে না, তবে ইহার পরিমাণ ও উপযুক্ত বিধি কথিত হইয়াছে।
একটা কথা বুঝাইতে বাকি আছে। বিধেয়াত্মা পুরুষের ইন্দ্রিয়সকলকে “রাগদ্বেষ বিমুক্ত”-অনুরাগ ও বিদ্বেষশূন্য বলা হইয়াছে। বিধেয়াত্মা পুরুষের ইন্দ্রিয় ভোগ্য বিষয়ে অনুরাগশূন্য কেন হইবে, তাহা বুঝান নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্বেষশূন্য বলিবার কারণ কি? ভোগবিষয়ে অনুরাগই ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক ধর্ম্ম, বিদ্বেষ অস্বাভাবিক, কখন দেখান যায় না। যাহার সম্ভাবনা নাই, তাহার নিষেধের কারণ কি? আর যদি উপভোগ্য বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের বিদ্বেষ ঘটে, সে ত ভালই-তাহা হইলে আর ইন্দ্রিয়সুখে প্রবৃত্তি থাকিবে না। তবে এ নিষেধ কেন?
উপভোগ্যে যে বিদ্বেষ ঘটে না, এমন নহে। রোগীর আহারে অরচি এবং অলসের ব্যায়ামসুখে অরুচি, উদাহরণ-স্বরুপ নির্দ্দিষ্ট করা যাইতে পারে। এ সকল শারীরক স্বাস্থ্যেরও লক্ষণ নহে, মানসিক স্বাস্থ্যেরও লক্ষণ নহে। অনেককে দেখিতে পাই, কিছুতেই পাড়ওয়ালা ধুতি পরিবেন না, চটি জুতা নহিলে পায়ে দিবেন না। ইঁহাদিগের চিত্ত আজিও বিকারশূন্য হয় নাই, যে ফিন্ফিনে কালাপেড়ে ধুতি নহিলে পরিবে না, তাহাদিগের চিত্ত যেমন এখনও বিকৃত, ইহাদিগের তেমনি। যখন সকলই সমান জ্ঞান হইবে, তখন ইহারা আর এরূপ আপত্তি করিবে না।
এই সকল ক্ষুদ্র উদাহরণে কথাটা যত ক্ষুদ্র বোধ হইতেছে, বস্তুতঃ কথাটা ততটা ছোট কথা নহে। একটা বড় উদাহরণ দ্বারা উহার গৌরব প্রতিপন্ন করিতেছি। রোমান কাথলিক ধর্ম্মোপদেষ্টাদিগের ইন্দ্রিয়বিশেষের তৃপ্তির প্রতি বিদ্বেষ-কার্য্যতঃ না হউক, বিধিতঃ বটে। এই জন্য তাঁহাদের মধ্যে চিরকৌমার বিহিত ছিল। ইহার ফলে কিরূপ বিশৃঙ্খলা ঘটিয়াছিল, তাহা ইতিহাসপাঠক মাত্রেই জানেন। কিন্তু আর্য্য ঋষিরা যথার্থ স্থিতপ্রজ্ঞ-কোন ইন্দ্রিয়ের প্রতি তাঁহাদের অনুরাগও নাই, বিদ্বেষও নাই। অতএব তাঁহারা ব্রহ্মচর্য্য সমাপন করিয়া, যথাকালে দারপরিগ্রহ করিতেন। কিন্তু তাঁহারা বিদ্বেষশূন্য, ইন্দ্রিয়ের প্রতি তেমনি অনুরাগশূন্য, অতএব কেবল ধর্ম্মতঃ সন্তানোৎপাদন জন্যই বিবাহ করিতেন, এবং সেই জন্যই স্বভাব-নির্দ্দিষ্ট সাময়িক নিয়মের অতিরিক্ত কখন ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করিতেন না।
65 “Makes the heart glad,”-পূর্ব্বোদ্ধৃত কান্তের ভক্তি দেখ।