শ্লোকত্রয়ের অর্থ এক্ষণে আমরা বুঝিতে পারিতেছি। বেদে নানা কাম্য কর্ম্মের বিধি আছে; বেদে বলে যে, সেই সকল বহুপ্রকার কাম্য কর্ম্মের ফলে স্বর্গাদি বহুবিধ ভোগৈশ্বর্য্য প্রাপ্তি হয়, সুতরাং আপাততঃ শুনিতে সে সকল কথা বড় মনোহারিণী। যাহারা কামনাপরায়ণ, আপনার ভোগৈশ্বর্য্য খুঁজে, সেই জন্য স্বর্গাদি কামনা করে, তাহাদের মন সেই সকল কথায় মুগ্ধ হয়। তাহারা কেবল বেদের দোহাই দিয়া বেড়ায়, বলে-ইহা ছাড়া আর ধর্ম্ম নাই। তাহারা মূঢ়। তাহাদের বুদ্ধি কখন ঈশ্বরে একাগ্র হইতে পারে না। কেন না, তাহাদের বুদ্ধি “বহুশাখা” ও “অনন্তা”, ইহা পূর্ব্বশ্লোকে কথিত হইয়াছে।

কথাটা বড় ভয়ানক ও বিস্ময়কর। ভারতবর্ষ এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেদশাসিত। আজিও বেদের যে প্রতাপ, ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের তাহার সহস্রাংশের এক অংশ নাই। সেই প্রাচীন কালে বেদের আবার ইহার সহস্রগুণ প্রতাপ ছিল। সাংখ্যপ্রবচনকার ঈশ্বর মানেন না-ঈশ্বর নাই, এ কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে বলিতে সাহস করিয়াছেন, তিনিও বেদ অমান্য করিতে সাহস করেন না- পুনঃ পুনঃ বেদের দোহাই দিতে বাধ্য হইয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণ মুক্তকন্ঠে বলিতেছেন, এই বেদবাদীরা মূঢ়, বিলাসী; ইহারা ঈশ্বরারাধনার অযোগ্য!

ইহার ভিতরে একটা ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিহিত আছে। তাহা বুঝাইবার আগে আর দুইটা কথা বলা আবশ্যক। প্রথমতঃ কৃষ্ণের ঈদৃশ উক্তি বেদের নিন্দা নহে, বৈদিক কর্ম্মবাদীদিগের নিন্দা। যাহারা বলে, বেদোক্ত কর্ম্মই (যথা, অশ্বমেধাদি) ধর্ম্ম, কেবল তাহাই আচরণীয়, তাহাদেরই নিন্দা। কিন্তু বেদে যে কেবল অশ্বমেধাদি যজ্ঞেরই বিধি আছে, আর কিছু নাই, এমন নহে। উপনিষদে যে অত্যুন্নত ব্রহ্মবাদ আছে, গীতা সম্পূর্ণরূপে তাহার অনুবাদিনী, তদুক্ত জ্ঞানবাদ অনেক সময়েই গীতায় উদ্ধৃত, সঙ্কলিত ও সম্প্রসারিত হইয়া নিষ্কাম কর্ম্মবাদ ও ভক্তিবাদের সহিত সমঞ্জসীভূত হইয়াছে। অতএব কৃষ্ণের এতদুক্তিকে সমস্ত বেদের নিন্দা বিবেচনা করা অনুচিত। তবে দ্বিতীয় কথা এই বক্তব্য যে, যাঁহারা বলেন যে, বেদে যাহা আছে, তাহাই ধর্ম্ম, তাহা ছাড়া আর কিছু ধর্ম্ম নহে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁহাদের মধ্যে নহেন। তিনি বলেন, (১) বেদে ধর্ম্ম আছে, ইহা মানি। (২) কিন্তু বেদে এমন অনেক কথা আছে, যাহা প্রকৃত ধর্ম্ম নহে-যথা, এই সকল জন্মকর্ম্মফলপ্রদা ক্রিয়াবিশেষবহুলা পুষ্পিতা কথা। (৩) তিনি আরও বলেন যে, এমন এক দিকে বেদে এমন কথা আছে, যাহা ধর্ম্ম নহে, আবার অপর দিকে অনেক তত্ত্ব যাহা প্রকৃত ধর্ম্মতত্ত্ব, অথচ বেদে নাই। ইহার উদাহরণ আমরা গীতাতেই পাইব। কিন্তু গীতা ভিন্ন মহাভারতের অন্য স্থানেও পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ কর্ণপর্ব্ব হইতে দুইটি শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি।

শ্রুতের্ধর্ম্ম ইতি হ্যেকে বদন্তি বহবো জনাঃ।
তত্তে ন প্রত্যসূয়ামি ন চ সর্ব্বং বিধীয়তে || ৫৬ ||
প্রভবার্থায় ভূতানাং ধর্ম্মপ্রবচং কৃতম্ || ৫৭ ||55

যদি ইহাকে বেদনিন্দা বলিতে চাহেন, তবে শ্রীকৃষ্ণ বেদনিন্দক এবং গীতার এবং মহাভারতের অন্যত্র বেদনিন্দা আছে। বস্তুতঃ ইহা এই পর্য্যন্ত বেদনিন্দা যে, এতদ্দ্বারা বেদের অসম্পূর্ণতা সূচিত হয়।

তত দূরে ইহাকে না হয়, বেদনিন্দাই বলা যাউক। এই বেদনিন্দার ভিতর একটি ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিহিত আছে বলিয়াছি, তাহা মৎপ্রণীত “ধর্ম্মতত্ত্ব” গ্রন্থে বুঝাইয়াছি। কিন্তু ঐ গ্রন্থ সম্প্রতি মাত্র প্রচারিত হইয়াছে। এ জন্য পাঠকদিগের সুলভ না হইতে পারে। অতএব প্রয়োজনীয় অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি।

“সাধারণ উপাসকের সহিত সচরাচর উপাস্য দেবের সে সম্বন্ধ দেখা যায়, বৈদিক ধর্ম্মে উপাস্য-উপাসকের সেই সম্বন্ধ ছিল। ‘হে ঠাকুর! আমার প্রদত্ত এই সোমরস পান কর। হবি ভোজন কর, আর আমাকে ধন দাও, সম্পদ্ দাও, পুত্র দাও, গোরু দাও, শস্য দাও, আমার শত্রুকে পরাস্ত কর।’ বড় জোর বলিলেন, “আমার পাপ ধ্বংস কর।’ দেবগণকে এইরূপ অভিপ্রায়ে প্রসন্ন করিবার জন্য বৈদিকেরা যজ্ঞাদি করিতেন। এইরূপ কাম্য বস্তুর উদ্দেশ্যে যজ্ঞাদি করাকে কাম্য কর্ম্ম বলে।

55 “অনেকে শ্রুতিকে ধর্ম্মপ্রমাণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। আমি তাহাতে দোষারোপ করি না। কিন্তু শ্রুতি সমুদায় ধর্ম্মতত্ত্ব নির্দ্দিষ্ট নাই। এই নিমিত্ত অনুমান দ্বারা অনেক স্থলে ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট করিতে হয়।” কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ-কর্ণপর্ব্ব, ৭০ অধ্যায়। সিংহ মহোদয় যে কাপি দেখিয়া অনুবাদ করিয়াছেন, তাহাতে এই শ্লোক দুটি ৭০ অধ্যায়ে আছে। কিন্তু অন্যত্র ৩৯ অধ্যায়ে ইহা পাওয়া যায়।