গুরু। অনেক সময়ে তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য। না করাই অধর্ম্ম।

শিষ্য। তাহার দুই একটা উদাহরণ শুনিতে ইচ্ছা করি।

গুরু। যে মাতা পিতার নিকট তুমি প্রাণ পাইয়াছ, যাঁহাদিগের যত্নে তুমি কর্ম্মক্ষম ও ধর্ম্মক্ষম হইয়াছ, তাঁহাদিগের রক্ষার্থ প্রয়োজনমতে আপনার প্রাণ বিসর্জ্জনই ধর্ম্ম, না করা অধর্ম্ম।

সেইরূপ প্রাণদানাদি উপকার যদি তুমি অন্যের কাছে পাইয়া থাক, তবে তাহার জন্যও ঐরূপ আত্মপ্রাণ বিসর্জ্জনীয়।

যাহাদের তুমি রক্ষক, তাহাদের জন্য আত্মপ্রাণ ঐরূপে বিসর্জ্জনীয়। এখন বিবেচনা করিয়া দেখ, তুমি রক্ষক কাহার। তুমি রক্ষক, (১) স্ত্রীপুত্রাদি পরিবারবর্গের, (২) স্বদেশের, (৩) প্রভুর, অর্থাৎ যে তোমাকে রক্ষার্থ বেতন দিয়া নিযুক্ত করিয়াছে, তাহার; (৪) শরণাগতের। অতএব স্ত্রীপুত্রাদি, স্বদেশ, প্রভু, এবং শরণাগত, এই সকলের রক্ষার্থ আপনার প্রাণ পরিত্যাগ করা ধর্ম্ম।

যাহারা আপনাদের রক্ষায় অক্ষম, মনুষ্য মাত্রেই তাঁহাদের রক্ষক। স্ত্রীলোক, বালক, বৃদ্ধ, পীড়িত, অন্ধ খঞ্জাদি অঙ্গহীন, ইহারা আত্মরক্ষায় অক্ষম। ইহাদের রক্ষার্থ প্রাণ পরিত্যাগ ধর্ম্ম।

এইরূপ আরও অনেক স্থান আছে। সকলগুলি গণনা করিয়া উঠা যায় না। প্রয়োজনও নাই। যাহার জ্ঞানার্জ্জনী ও কার্য্যকারিণী বৃত্তি অনুশীলিত ও সামঞ্জস্য প্রাপ্ত হইয়াছে, সে সকল অবস্থাতেই বুঝিতে পারিবে যে, এই স্থলে প্রাণ পরিত্যাগ ধর্ম্ম, এই স্থলে অধর্ম্ম।

শিষ্য। আপনার কথার তাৎপর্য্য এই বুঝিলাম যে, আত্মপ্রীতি প্রীতিবৃত্তির বিরোধী হইলেও, ঘৃণার যোগ্য নহে। উপযুক্ত নিয়মে উহার সীমাবদ্ধ করিয়া উহারও সম্যক্ অনুশীলন কর্ত্তব্য। বটে?

গুরু। বস্তুতঃ যদি আত্ম-পর সমান হইল, তবে আত্মপ্রীতি ও জাগতিক প্রীতি, ভিন্ন বিবেচনা করাও উচিত নহে। উপযুক্তরূপে উভয়ে অনুশীলিত ও সামঞ্জস্যবিশিষ্ট হইলে আত্মপ্রীতি জাগতিক প্রীতির অন্তর্গত হইয়া দাঁড়ায়। কেন না, আমি ত জগতের বাহিরে নই। ধর্ম্মের, বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম্মের মূল একমাত্র ঈশ্বর। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন; এজন্য সর্ব্বভূতের হিতসাধন আমাদের ধর্ম্ম, কেন না, বলিয়াছি যে-সকল বৃত্তিকে ঈশ্বরমুখী করাই মনুষ্যজন্মের চরম উদ্দেশ্য। যদি সর্ব্বভূতের হিতসাধন ধর্ম্ম হয়, তবে পরেরও হিতসাধন যেমন আমার ধর্ম্ম, তেমনি আমার নিজেরও হিতসাধন আমার ধর্ম্ম। কারণ, আমিও সর্ব্বভূতের অন্তর্গত; ঈশ্বর যেমন অপর ভূতে আছেন, তেমনি আমাতেও আছেন। অতএব পরেরও রক্ষাদি আমার ধর্ম্ম এবং আপনারও রক্ষাদি আমার ধর্ম্ম। আত্মপ্রীতি ও জাগতিক প্রীতি এক।

শিষ্য। কিন্তু কথাটার গোলযোগ এই যে, যখন আত্মহিত এবং পরহিত পরস্পর বিরোধী তখন আপনার হিত করিব, না পরের হিত করিব? পূর্ব্বগামী ধর্ম্মবেত্তৃগণের মত এই যে, আত্মহিতে ও পরহিতে পরস্পর বিরোধ হইলে, পরহিত সাধনই ধর্ম্ম।