ধর্ম্মতত্ত্ব
গুরু। মুখ্য ভক্তির অনেক বিঘ্ন আছে। যাহা দ্বারা সেই সকল বিঘ্ন বিনষ্ট হয়, শাণ্ডিল্যসূত্রপ্রণেতা তাহারই নাম দিয়াছেন গৌণ ভক্তি। ঈশ্বরের নামকীর্ত্তন, ফল পুষ্পাদির দ্বারা তাঁহার অর্চ্চনা, বন্দনা, প্রতিমাদির পূজা-এ সকল গৌণ ভক্তির লক্ষণ। সূত্রের টীকাকার স্বয়ং স্বীকার করিয়াছেন যে, এই সকল অনুষ্ঠান ভক্তিজনক মাত্র; ইহার ফলান্তর নাই।*
শিষ্য। তবে আপনার মত এই বুঝিলাম যে, পূজা, হোম, যজ্ঞ, নামসঙ্কীর্ত্তন, সন্ধ্যাবন্দনাদি বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম্মের বিরোধী নহে। তবে উহাতে কোন প্রকার ঐহিক বা পারমার্থিক ফল নাই,-ঐ সকল কেবল ভক্তির সাধন মাত্র।
গুরু। তাহাও নিকৃষ্ট সাধন। উৎকৃষ্ট সাধন, যাহা তোমাকে কৃষ্ণোক্তি উদ্ধৃত করিয়া শুনাইয়াছি। যে তাহাতে অক্ষম, সেই পূজাদি করিবে। তবে স্তুতি বন্দনা প্রভৃতি সম্বন্ধে একটা বিশেষ কথা আছে। যখন কেবল ঈশ্বরচিন্তাই উহার উদ্দেশ্য, তখন উহা মুখ্য ভক্তির লক্ষণ। যথা বিপন্মুক্ত প্রহ্লাদকৃত বিষ্ণু-স্তুতি মুখ্য উক্তি। আর “আমার পাপ ক্ষালিত হউক,” “আমায় সুখে দিন যাউক,” ইত্যাদি সকাম সন্ধ্যাবন্দনা, স্তুতি বা Prayer গৌণভক্তিমধ্যে গণ্য। আমি তোমাকে পরামর্শ দিই যে, কৃষ্ণোক্তির অনুবর্ত্তী হইয়া ঈশ্বরের কর্ম্মতৎপর হও।
শিষ্য। সেও ত পূজা, হোম, যাগ যজ্ঞ-
গুরু। সে আর একটি ভ্রম। এ সকল ঈশ্বরের জন্য কর্ম্ম নহে; এ সকল সাধকের নিজ মঙ্গলোদ্দিষ্ট কর্ম্ম-সাধকের নিজের কার্য্য; ভক্তির বৃদ্ধি জন্যও যদি এ সকল কর, তথাপি তোমার নিজের জন্য হইল। ঈশ্বর জগন্ময়; জগতের কাজই তাঁহার কাজ। অতএব যাহাতে জগতের হিত হয়, সেই সকল কর্ম্মই কৃষ্ণোক্ত “মৎকর্ম্ম”; তাহার সাধনে তৎপর হও, এবং সমস্ত বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলনের দ্বারায় সে সকল সম্পাদনের যোগ্য হও। তাহা হইলে যাঁহার উদ্দিষ্ট সেই সকল কর্ম্ম, তাঁহাতে মন স্থির হইবে। তাহা হইলে ক্রমশঃ জীবন্মুক্ত হইবে। জীবন্মুক্তিই সুখ। বলিয়াছি, “সুখের উপায় ধর্ম্ম।” এই জীবন্মুক্তিসুখের উপায়ই ধর্ম্ম। রাজসম্পাদাদি কোন সম্পদেই তত সুখ নাই।
যে ইহা না পারিবে, সে গৌণ উপাসনা অর্থাৎ পূজা, নামকীর্ত্তন, সন্ধ্যাবন্দনাদির দ্বারা ভক্তির নিকৃষ্ট অনুশীলনে প্রবৃত্ত হউক। কিন্তু তাহা করিতে হইলে, অন্তরের সহিত সে সকলের অনুষ্ঠান করিবে। তদ্ব্যতীত ভক্তির কিছুমাত্র অনুশীলন হয় না। কেবল বাহ্যাড়ম্বরে বিশেষ অনিষ্ট জন্মে। উহা তখন ভক্তির সাধন না হইয়া কেবল শঠতার সাধন হইয়া পড়ে। তাহার অপেক্ষা সর্ব্বপ্রকার সাধনের অভাবেই ভাল। কিন্তু, যে কোন প্রকার সাধনে প্রবৃত্ত নহে, সে শঠ ও ভণ্ড হইতে শ্রেষ্ঠ হইলেও, তাহার সঙ্গে পশুগণের প্রভেদ অল্প।
শিষ্য। তবে, এখনকার অধিকাংশ বাঙ্গালি হয় ভণ্ড ও শঠ, নয় পশুবৎ।
গুরু। হিন্দুর অবনতির এই একটা কারণ। কিন্তু তুমি দেখিবে, শীঘ্রই বিশুদ্ধ ভক্তির প্রচারে হিন্দু নবজীবন প্রাপ্ত হইয়া, ক্রমওয়েলের সমকালিক ইংরেজের মত বা মহম্মদের সমকালিক আরবের মত অতিশয় প্রতাপান্বিত হইয়া উঠিবে।
শিষ্য। কায়মনোবাক্যে জগদীশ্বরের নিকট সেই প্রার্থনা করি।
* ভক্ত্যা কীর্ত্তনেন ভক্ত্যা দানেন পরাভক্তিং সাধয়েদিতি * * ন ফলান্তরার্থং গৌরবাদিতি।