শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহ নিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত || ১৪ ||
আগমাপায়িনোহ নিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত || ১৪ ||
হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়গণ ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে তৎসংযোগ43, ইহাই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখজনক। সে সকলের উৎপত্তি ও অপায় আছে, অতএব তাহা অনিত্য, অতএব হে ভারত! সে সকল সহ্য কর। ১৪।
একাদশ শ্লোকে বলা হইল যে, যাহার জন্য শোক করা উচিত নহে, তাহার জন্য তুমি শোক করিতেছ। দ্বাদশ শ্লোকে এরূপ অনুযোগ করিবার কারণ নির্দ্দেশ করা হইল। সে কারণ এই যে, কেহই ত মরিবে না; কেন না, আত্মা অবিনাশী। তুমি কাটিয়া পড়িলেও সে থাকিবে, কেন না, তাহার আত্মা থাকিবে। একাদশ শ্লোক পাঠে জানা যায় যে, যখন গীতা প্রণীত হয়, তখন জন্মান্তর জনসমাজে গৃহীত। একাদশ শ্লোকে অর্জ্জুনের আপত্তি আশঙ্কা করিয়া, ভগবান্ তাহারই খণ্ডন করিতেছেন। অর্জ্জুন বলিতে পারেন, আত্মা না হয় রহিল, কিন্তু যখন দেহ গেল, তখন আমার আত্মীয় ব্যক্তি, যাঁহার জন্য শোক করিতেছি, সে আর রহিল কৈ? দেহান্তর প্রাপ্ত হইলে সে ত ভিন্ন ব্যক্তি হইল। এই আপত্তির আশঙ্কা করিয়া ভগবান্ ত্রয়োদশ শ্লোকে বলিতেছেন যে, এরূপ ভেদ কল্পনা করা অনুচিত; কেন না, যেমন কৌমার, যৌবন, জরা এক ব্যক্তিরই অবস্থান্তর মাত্র, তেমনি দেহান্তরপ্রাপ্তিও অবস্থান্তর মাত্র। ইহাতেও অর্জ্জুন আপত্তি করিতে পারেন যে, না হয় স্বীকার করা গেল যে, দেহান্তরেও দেহীর একতা থাকে-কিন্তু মৃত্যুর একটা দুঃখ-কষ্ট ত আছেই? এই স্বজনগণ সেই কষ্ট পাইবে-তাহা স্মরণ করিয়া শোক করিব না কেন? তাহাদের বিরহে কাতর হইব না কেন?
তাহার উত্তরে ভগবান্ এই চতুর্দ্দশ শ্লোকে বলিতেছেন যে, যে সকলকে তুমি এই দুঃখ বলিতেছ, তাহা ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ-জনিত। যতক্ষণ সংযোগ থাকে, ততক্ষণ সেই দুঃখ থাকে, সংযোগের অভাবে আর সে দুঃখ থাকে না। যেমন যতক্ষণ ত্বকের সঙ্গে রৌদ্রাদি উত্তাপের বা হিমের শৈত্যের সংযোগ হয়, ততক্ষণ উষ্ণ বা শীতস্বরূপ যে দুঃখ, তাহা অনুভূত করি, রৌদ্রাদির অভাব হইলে আর তাহা থাকে না। যাহা থাকিবে না, অনিত্য, তাহা সহ্য করাই উচিত। যে দুঃখ সহ্য করিলেই ফুরাইবে, তাহার জন্য কষ্ট বিবেচনা করিব কেন?
এই সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য্যগুণ থাকিলেই জীবন মধুর হয়। অভ্যাস করিলে অভ্যাসগুণে আর কোন দুঃখকেই দুঃখবোধ হয় না। তার পর এই গীতোক্ত সর্ব্বানন্দময়ী ভক্তিতে মনুষ্যের জীবন অপরিসীম সুখে আপ্লুত হয়। দুঃখমাত্র থাকে না। জীবনকে সুখময় করিবার জন্য, গোড়াতে এই দুঃখসহিষ্ণুতা আছে-তাহা ব্যতীত কিছু হইবে না। ইন্দ্রিয়গণের সহিত বহির্ব্বিষয়ের-সংযোগজনিত যে সুখ-ভোগবিলাসাদি, তাহাও দুঃখের মধ্যে গণ্য করিতে হইবে; কেন না, তাহার প্রতি অনুরাগ জন্মিলে, তাহার অভাবও দুঃখ বলিয়া বোধ হয়। এই জন্য “শীতোষ্ণ সুখদুঃখ” একত্র গণনা করা হইয়াছে।44
43 মাত্রাশ্চ স্পর্শাশ্চ ইতি শঙ্কর:।
44 এখানে মূলে যে মাত্রা শব্দ আছে ও মাত্রাস্পর্শ পদ আছে, তাহার দুই প্রকার অর্থ করা যায়। উহার দ্বারা ইন্দ্রিয়গণকে বুঝাইতে পারে, এবং ইন্দ্রিয়গণের বিষয়কেও বুঝাইতে পারে। শঙ্করাচার্য্য বলেন,-“মাত্রা আভির্ম্মীয়ন্তে শব্দাদয় ইতি শ্রোতাদীনীন্দ্রিয়াণি, মাত্রাণাং স্পর্শা: শব্দাদিভি: সংযোগা:।” শ্রীধর স্বামীও ঐরূপ বলেন, যথা-“মীয়ন্তে জ্ঞায়ন্তে বিষয়া আভিরিতি মাত্রা ইন্দ্রিয়বৃত্তয়স্তাসাং স্পর্শা বিষয়ৈ: সহ সম্বন্ধা: (মাত্রাস্পর্শা:)।” মধুসূদন সরস্বতীও ঠিক তাই বলেন। পক্ষান্তরে, বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী বলেন, “মাত্রা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যবিষয়া:।” তাতেও বড় আসিয়া যাইত না, কিন্তু একজন ইংরেজ অনুবাদক Davis স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, এই মাত্রা শব্দ লাটিন ভাষায় Materia ও ইংরাজিতে matter সুতরাং তিনি “মাত্রাস্পর্শা:” পদের অনুবাদে “Matter-contacts” লিখিয়াছেন। পরিমাণজ্ঞানের জন্য ইন্দ্রিয়বিষয়েরও যে আবশ্যকতা, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। সাংখ্যদর্শনের “তন্মাত্র” শব্দের তাৎপর্য্য বিচার করা কর্ত্তব্য। বলা বাহুল্য যে, আমি বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী ও ডেভিস সাহেবকে পরিত্যাগ করিয়া শঙ্করাচার্য্য ও শ্রীধর স্বামীর অনুসরণ করিয়াছি।