যে জ্যেষ্ঠতাতপুত্রের হৃদয়রুধির পান করিয়া নৃত্য করিয়াছে, সে রাক্ষসের কাছে মাথায় গদাঘাত ও ঊরুতে গদাঘাতে তফাৎ কি? যে বৃকোদর দ্রোণভয়ে মিথ্যাপ্রবঞ্চনার সময়ে প্রধান উদ্যোগী বলিয়া চিত্রিত হইয়াছেন, তিনি ঊরুতে গদাঘাতের জন্য অন্যের উপদেশসাপেক্ষ হইতে পারেন না। কিন্তু সেরূপ কিছু হইল না। ভীম ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা ভুলিয়া গেলেন। বলিয়াছি, দ্বিতীয় স্তরের কবি (এখানে তাঁহারই হাত দেখা যায়) চরিত্রের সুসঙ্গতি রক্ষণে সম্পূর্ণ অমনোযোগী। তিনি এখানে ভীমের চরিত্রের কিছুমাত্র সুসঙ্গতি রাখিলেন না; অর্জুনেরও নহে। ভীম ভুলিয়া গেলেন যে, ঊরুভঙ্গ করিতে হইবে; আর যে পরমধার্মিক অর্জুন, দ্রোণবধের সময়, তাঁহার অস্ত্রগুরু, ধর্মের আচার্য, সখা, এবং পরমশ্রদ্ধার পাত্র কৃষ্ণের কথাতেও মিথ্যা বলিতে স্বীকৃত হয়েন নাই, তিনি এক্ষণে স্বেচ্ছাক্রমে অন্যায়যুদ্ধে ভীমকে প্রবর্তিত করিলেন। কিন্তু কথাটা কৃষ্ণ হইতে উৎপন্ন না হইলে, কবির উদ্দেশ্য সফল হয় না। অতএব কথাটা এই প্রকারে উঠিল—

অর্জুন ভীম-দুর্যোধনের যুদ্ধ দেখিয়া কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ইহাদিগের মধ্যে গদাযুদ্ধে কে শ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণ বলিলেন, ভীমের বল বেশী, কিন্তু দুর্যোধনের গদাযুদ্ধে যত্ন ও নৈপুণ্য অধিক। বিশেষ যাহারা প্রথমতঃ প্রাণভয়ে পলায়ন করিয়া পুনরায় সমরে শত্রুগণের সম্মুখীন হয়, তাহাদিগকে জীবিতনিরপেক্ষ ও একাগ্রচিত্ত বলিয়া বিবেচনা করিতে হইবে। জীবিতাশানিরপেক্ষ হইয়া সাহস সহকারে যুদ্ধ করিলে, সংগ্রামে সে বীরকে কেহই পরাভব করিতে পারে না। অতএব যদি ভীম দুর্যোধনকে অন্যায়যুদ্ধে সংহার না করেন, তবে দুর্যোধন জয়ী হইয়া যুধিষ্ঠিরের কথামত পুনর্বার রাজ্যলাভ করিবে।

কৃষ্ণের এইরূপ কথা শুনিয়া অর্জুন “স্বীয় বাম জানু আঘাত করতঃ ভীমকে সঙ্কেত করিলেন।” তার পর ভীম দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করিয়া তাহাকে নিপাতিত করিলেন।

যেমন ন্যায় ঈশ্বরপ্রেরিত, অন্যায়ও তেমনি ঈশ্বরপ্রেরিত। ইহাই এখানে দ্বিতীয় স্তরের কবির উদ্দেশ্য।

যুদ্ধকালে দর্শকমধ্যে, বলরাম উপস্থিত ছিলেন। ভীম ও দুর্যোধন উভয়েই গদাযুদ্ধে তাহার শিষ্য। কিন্তু দুর্যোধনই প্রিয়তর। রেবতীবল্লভ সর্বদাই দুর্যোধনের পক্ষপাতী। এক্ষণে দুর্যোধন, ভীম কর্তৃক অন্যায়যুদ্ধে নিপাতিত দেখিয়া, অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া, লাঙ্গল উঠাইয়া তিনি ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন। বলা বাহুল্য যে, বলরামের স্কন্ধে সর্বদাই লাঙ্গল, এই জন্য তাঁহার নাম হলধর। কেন তাঁহার এ বিড়ম্বনা, যদি কেহ এ কথা জিজ্ঞাসা করেন, তবে তাহার কিছু উত্তর দিতে পারিব না। যাই হউক, কৃষ্ণ বলরামকে অনুনয় বিনয় করিয়া কোনরূপে শান্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। বলরাম কৃষ্ণের কথায় সন্তুষ্ট হইলেন না। রাগ করিয়া সে স্থান ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।

তার পর একটা বীভৎস ব্যাপার উপস্থিত হইল। ভীম, নিপাতিত দুর্যোধনের মাথায় পদাঘাত করিতেছিলেন। যুধিষ্ঠির নিবারণ করিয়াছিলেন, কিন্তু ভীম তাহা শুনেন নাই। কৃষ্ণ তাঁহাকে এই কদর্য আচরণে নিযুক্ত দেখিয়া তাঁহাকে নিবারণ না করার জন্য যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করিলেন। এদিকে, পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ দুর্যোধনের নিপাত জন্য ভীমের বিস্তর প্রশংসা ও দুর্যোধনের প্রতি কটূক্তি করিতে লাগিলেন। কৃষ্ণ তাহাতে বিরক্ত হইয়া বলিলেন,

“মৃতকল্প শত্রুর প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করা কর্তব্য নহে।”

কৃষ্ণের এই সকল কথা কৃষ্ণের ন্যায় আদর্শ পুরুষের উচিত। কিন্তু ইহার পর যাহা গ্রন্থমধ্যে পাই, তাহা অতিশয় আশ্চর্য ব্যাপার।

প্রথম আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, কৃষ্ণ অন্যকে বলিলেন, “মৃতকল্প শত্রুর প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করা কর্তব্য নহে।” কিন্তু ইহা বলিয়াই নিজে দুর্যোধনকে কটূক্তি করিতে লাগিলেন।

দুর্যোধনের উত্তর দ্বিতীয় আশ্চর্য ব্যাপার। দুর্যোধন তখনও মরেন নাই, ভগ্নোরু হইয়া পড়িয়াছিলেন। এক্ষণে কৃষ্ণের কটূক্তি শুনিয়া কৃষ্ণকে বলিতে লাগিলেন,