শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
আপাততঃ শুনিলে এ সকল কথা পাশ্চাত্ত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত অনেকের নিকট অশ্রদ্ধেয় বলিয়া বোধ হইতে পারে। কিন্তু একটু বিচার করিলে আর এক রকম বোধ হইবে।
এই জন্মান্তরবাদ হিন্দুধর্ম্মে অতিশয় প্রবল। উপনিষদুক্ত হিন্দুধর্ম্ম, গীতোক্ত হিন্দুধর্ম্ম, পৌরাণিক হিন্দুধর্ম্ম বা দার্শনিক হিন্দুধর্ম্ম, সকল প্রকার হিন্দুধর্ম্ম ইহার উপর স্থাপিত। যেমন সূত্রে মণি গ্রথিত থাকে, হিন্দুধর্ম্মের সকল তত্ত্বগুলিই তেমনি এই সূত্রে গ্রথিত আছে। অতএব এই তত্ত্বটি আমাদিগকে বড় যত্নপূর্ব্বক বুঝিতে হইবে। কথাটাও বড় গুরুতর,-অতি দুরূহ। আমরা বাল্যকাল হইতে কথাটা শুনিয়া আসিতেছি, ইহা আমাদের বাল্য-সংস্কারের মধ্যে, সুতরাং আমরা সচরাচর ইহার গৌরব অনুভব করি না। কিন্তু বিদেশীয় এবং অন্যধর্ম্মাবলম্বী চিন্তাশীল পণ্ডিতেরা কুসংস্কারবর্জ্জিত হইয়া ইহার আলোচনাকালে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েন! গীতার অনুবাদকার টমসন সাহেব এতৎসম্বন্ধে লিখিয়াছেন, “Undoubtedly it is the most novel and starting idea ever started in any age or country” টেলর সাহেব ইহাকে “One of the most remarkable developments of ethical speculation” বলিয়া প্রশংসিত করিয়াছেন।34
কথাটা যদি এমনই গুরুতর, তবে ইহা আর একটু ভাল করিযা বুঝিবার চেষ্টা করা যাউক।
বলা হইয়াছে, জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ, ইহা হিন্দুশাস্ত্রের উক্তি। পরমাত্মা বা পরব্রহ্মের অংশ তাঁহা হইতে পার্থক্য লাভ করিল কি প্রকারে? তাঁহার দেহবদ্ধাবস্থা বা কেন? হিন্দুশাস্ত্রে ইহার যে উত্তর আছে, তাহা বুঝাইতেছি। ঈশ্বরের অশেষ প্রকার শক্তি আছে। একটি শক্তির নাম মায়া। এই মায়া কি, তাহা স্থানান্তরে বুঝাইব। এই মায়ার দ্বারা তিনি আপনার সত্তাকে জগতে পরিণত করিয়াছেন। তিনি চৈতন্যময়; তাঁহা ভিন্ন আর চৈতন্য নাই–অতএব জগতে যে চৈতন্য দেখি, ইহা তাঁহারই অংশ; তাঁহার সিসৃক্ষাক্রমে এই অংশ মায়ার বশীভূত হইয়া পৃথক্ ও দেহবদ্ধ হইয়াছে। যদি সেই পৃথগ্ভূত চৈতন্য বা জীবাত্মা কোন প্রকারে মায়ার বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারে, তবে আর তাহার পার্থক্য থাকিবে কেন? পার্থক্য ঘুচিয়া যাইবে, জীবাত্মা আবার পরমাত্মায় বিলীন হইবে।
এখন জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে, জীবাত্মা এই মায়াকে অতিক্রম করিবে কি প্রকারে? যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা বা নিয়োগক্রমেই বদ্ধ হইয়া থাকে, তবে আবার বিমুক্ত হইবার সাধ্য কি? ইহার উত্তর এই যে ঈশ্বরের নিয়োগ এরূপ নহে যে, জীবাত্মা চিরকালই মায়াবদ্ধ থাকিবে। তিনি যে সকল নিয়ম করিয়াছেন, মায়ার অতিক্রমের উপায়ও তাহার ভিতরে রাখিয়াছেন। সে উপায় কি, তদ্বিষয়ে মতভেদ আছে। কেহ বলেন, জ্ঞানেই সেই মায়াকে অতিক্রম করা যায়; কেহ বলেন-কর্ম্মে, কেহ বলেন-ভক্তিতে। এই সকল মতের মধ্যে কোন্টি সত্য বা কোন্টি অসত্য, তাহার বিচার পশ্চাৎ করা যাইবে। এখন সকলগুলিই সত্য, ইহা স্বীকার করিয়া লওয়া যাউক। এখন এইগুলিই যদি ঈশ্বরে বিলীন হইবার উপায় হয়, তবে যে ব্যক্তি ইহজীবনে জ্ঞান, কর্ম্ম বা ভক্তির সমুচিত অনুষ্ঠান করে নাই, সে ঈশ্বরে লয় বা মুক্তি লাভ করিবে না। তবে সে ব্যক্তির আত্মা, মৃত্যুর পর কোথায় যাইবে? আত্মা অবিনশ্বর; সুতরাং দেহভ্রষ্ট আত্মাকে কোথাও না কোথাও যাইতে হইবে।
ইহার এক উত্তর এই হইতে পারে যে, দেহভ্রষ্ট আত্মা কর্ম্মানুসারে স্বর্গে বা নরকে যাইবে। স্বর্গ বা নরক প্রভৃতি লোকান্তরের অস্তিত্বের প্রমাণাভাব। কিন্তু প্রমাণের কথা এখন থাক। স্বীকার করা যাউক, কর্ম্মফলানুসারে আত্মা স্বর্গে বা নরকে যায়। এখন জিজ্ঞাস্য যে, জীবাত্মা স্বর্গে বা নরকে কিয়ৎকালের জন্য যায়, না অনন্তকালের জন্য যায়?
34 Primitive Culture, Vol. I, p. 12.