কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
যিনি ভগবদ্গীতা-পর্বাধ্যায়ে বলিয়াছেন যে, ধর্মসংরক্ষণের জন্যই যুগে যুগে অবতীর্ণ হই; যাঁহার চরিত্র, এ পর্যন্ত আদর্শ ধার্মিকের চরিত্র বলিয়াই প্রতিভাত হইয়াছে, যাঁহার ধর্মে দার্ঢ্য শত্রুগণ কর্তৃক স্বীকৃত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে,# তিনি কি না ডাকিয়া বলিতেছেন, “তোমরা ধর্ম পরিত্যাগ কর! তাই বলিতেছিলাম, মহাভারত নানা হাতের রচনা; যাঁহার যেরূপ ইচ্ছা, তিনি সেইরূপ গড়িয়াছেন।
কৃষ্ণ বলিতে লাগিলেন,
“আমার নিকট নিশ্চিত বোধ হইতেছে যে, অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছেন, ইহা জানিতে পারিলে দ্রোণ আর যুদ্ধ করিবেন না। অতএব কোন ব্যক্তি উঁহার নিকট গমনপূর্বক বলুন যে অশ্বত্থামা সংগ্রামে বিনষ্ট হইয়াছেন।”
অর্জুন মিথ্যা বলিতে অস্বীকৃত হইলেন, যুধিষ্ঠির কষ্টে তাহাতে সম্মত হইলেন। ভীম বিনা বাক্যব্যয়ে অশ্বত্থামা নামক একটা হস্তীকে মারিয়া আসিয়া দ্রোণাচার্যকে বলিলেন, অশ্বত্থামা মারিয়াছেন।?”! দ্রোণ জানিতেন, তাঁহার পুত্র “অমিতবলবিক্রমশালী, এবং শত্রুর অসহ্য”—অতএব ভীমের কথা বিশ্বাস করিলেন না। ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিহত করিবার চেষ্টায় মনোযোগী হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু পুনশ্চ আবার যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, অশ্বত্থামার মৃত্যুর কথা সত্য কি না? যুধিষ্ঠির কখনও অধর্ম করেন না, এবং অসত্য বলেন না, এজন্য তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি বলিলেন, অশ্বত্থামা কুঞ্জর মরিয়াছে—কিন্তু কুঞ্জর শব্দটা অব্যক্ত রহিল।!!
তাহাতেই বা কি হইল? দ্রোণ প্রথমে বিমনায়মান হইলেন বটে, কিন্তু তৎপরে অতি ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহার মৃত্যুস্বরূপ ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহার আপনার সাধ্যের অতীত যুদ্ধ করিয়া, নিরস্ত্র ও বিরথ হইয়া দ্রোণহস্তে মরণাপন্ন হইলেন। তখন ভীম গিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করিলেন, এবং দ্রোণাচার্যের রথ ধারণ করিয়া কতকগুলি কথা বলিলেন, তাহাই দ্রোণকে যুদ্ধে পরাঙ্মুখ করিবার পক্ষে যথেষ্ট। ভীম বলিলেন,
“হে ব্রাহ্মণ! যদি স্বধর্মে অসন্তুষ্ট শিক্ষিতাস্ত্র অধম ব্রাহ্মণগণ সমরে প্রবৃত্ত না হন, তাহা হইলে ক্ষত্রিয়গণের কখনই ক্ষয় হয় না। পণ্ডিতেরা প্রাণিগণের হিংসা না করাই প্রধান ধর্ম বলিয়া নির্দেশ করেন। সেই ধর্ম প্রতিপালন করা ব্রাহ্মণের অবশ্য কর্তব্য; আপনিই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ; কিন্তু চণ্ডালের ন্যায় অজ্ঞানান্ধ হইয়া পুত্র ও কলত্রের উপকারার্থ অর্থলালসা নিবন্ধন বিবিধ ম্লেচ্ছজাতি ও অন্যান্য প্রাণিগণের প্রাণ বিনাশ করিতেছেন। আপনি এক পুত্রের উপকারার্থ স্বধর্ম পরিত্যাগপূর্বক স্বকার্য সাধনে প্রবৃত্ত হইয়া অসংখ্য জীবের জীবন নাশ করিয়া কি নিমিত্ত লজ্জিত হইতেছেন না?”
কথাগুলি সকলই সত্য। ইহার পর আর তিরস্কার কি আছে? ইহাতেও দুর্যোধনের ন্যায় দুরাত্মার মত ফিরিতে পারে না বটে, কিন্তু দ্রোণাচার্য ধর্মাত্মা; ইহাই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট। ইহার পর অশ্বত্থামার মৃত্যুর কথাটা আর না তুলিলেও চলিত। কিন্তু তাহাও এখানে আবার পুনরুক্ত হইয়াছে।
# ধৃতরাষ্ট্রবাক্য দেখ।
! গোপালভাঁড় এইরূপ “কৃষ্ণ পাইয়াছিল।”
!! “অশ্বত্থামা হত ইতি গজ”-এ কথাটা মহাভারতের নহে। বোধ হয় কথকেরা তৈয়ার করিয়া থাকিবেন। মূল মহাভারতে ইহা নাই। মহাভারতে আছে,
তমতথ্যভয়ে মগ্নো জয়ে সক্তো যুধিষ্ঠিরঃ।
অব্যক্তমব্রবীদ্বাক্যং হতঃ কুঞ্জর ইত্যুত || ১৯১ ||
! গোপালভাঁড় এইরূপ “কৃষ্ণ পাইয়াছিল।”
!! “অশ্বত্থামা হত ইতি গজ”-এ কথাটা মহাভারতের নহে। বোধ হয় কথকেরা তৈয়ার করিয়া থাকিবেন। মূল মহাভারতে ইহা নাই। মহাভারতে আছে,
তমতথ্যভয়ে মগ্নো জয়ে সক্তো যুধিষ্ঠিরঃ।
অব্যক্তমব্রবীদ্বাক্যং হতঃ কুঞ্জর ইত্যুত || ১৯১ ||