কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ—দ্রোণবধ
প্রাচীন ভারতবর্ষে কেবল ক্ষত্রিয়েরাই যুদ্ধ করিতেন, এমত নহে। ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য যোদ্ধার কথা মহাভারতেই আছে। দুর্যোধনের সেনানায়কদিগের মধ্যে তিন জন প্রধান বীর ব্রাহ্মণ;— দ্রোণ, তাঁহার শ্যালক কৃপ, এবং তাঁহার পুত্র অশ্বত্থামা। অন্যান্য বিদ্যার ন্যায়, ব্রাহ্মণেরা যুদ্ধবিদ্যারও আচার্য ছিলেন। দ্রোণ ও কৃপ, এইরূপ যুদ্ধাচার্য। এই জন্য ইঁহাদিগকে দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্য বলিত।
এদিকে ব্রাহ্মণের সঙ্গে যুদ্ধে বিপদ্ও বেশী। কেন না, রণেও ব্রাহ্মণকে বধ করিলে, ব্রহ্মহত্যার পাতক ঘটে। অন্ততঃ মহাভারতকার এই কারণ, ব্রাহ্মণ যোদ্ধৃগণকে লইয়া বড় বিপন্ন, ইহা স্পষ্টই দেখা যায়। এই জন্য কৃপ অশ্বত্থামা যুদ্ধে মরিল না। কৌরবপক্ষীয় সকলেই মরিল, কেবল তাঁহারা দুই জনে মরিলেন না; তাঁহারা অমর বলিয়া গ্রন্থকার নিষ্কৃতি পাইলেন। কিন্তু দ্রোণাচার্যকে না মারিলে চলে না; ভীষ্মের পর তিনি সর্বপ্রধান যোদ্ধা; তিনি জীবিত থাকিতে পাণ্ডবেরা বিজয়লাভ করিতে পারেন না। কিন্তু এ কথাও গ্রন্থকার বলিতে অনিচ্ছুক যে, ধার্মিক রাজগণের মধ্যে কেহ তাঁহাকে মারিয়া ব্রহ্মহত্যার ভাগী হইল। বিশেষতঃ দ্রোণাচার্যকে দ্বৈরথযুদ্ধে পরাজিত করিতে পারে, পাণ্ডবপক্ষে এমন বীর অর্জুন ভিন্ন আর কেহই নাই; কিন্তু দ্রোণাচার্য অর্জুনের গুরু, এজন্য অর্জুনের পক্ষে বিশেষরূপে অবধ্য। তাই গ্রন্থকার একটা কৌশল অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছেন।
পাণ্ডবভার্যা দ্রৌপদীর পিতা দ্রুপদ রাজার সঙ্গে পূর্বকালে বড় বিবাদ হইয়াছিল। দ্রুপদ, দ্রোণের বিক্রমের সমকক্ষ হইতে পারেন নাই—অপদস্থ ও অপমানিত হইয়াছিলেন। এজন্য তিনি দ্রোণবধার্থ যজ্ঞ করিয়াছিলেন। যজ্ঞকুণ্ড হইতে দ্রোণবধকারী পুত্র উদ্ভূত হয়—নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন। ধৃষ্টদ্যুম্ন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদিগের সেনাপতি। তিনিই দ্রোণবধ করিবেন, পাণ্ডবদিগের এই ভরসা। যিনি ব্রহ্মবধার্থ দৈবকর্মজাত, ব্রহ্মবধ তাঁহার পক্ষে পাপ নয়।
কিন্তু মহাভারত এক হাতের নয়, নানা রচয়িতা নানা দিকে ঘটনাবলী যথেচ্ছা লইয়া গিয়াছেন। পনের দিবস যুদ্ধ হইল, ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের কিছুই করিতে পারিলেন না। তাঁহার নিকট পরাভূত হইলেন। অতএব দ্রোণ মরার ভরসা নাই—প্রত্যহ পাণ্ডবদিগের সৈন্যক্ষয় হইতে লাগিল। তখন দ্রোণবধার্থ একটা ঘোরতর পাপাচারের পরামর্শ পাণ্ডব পক্ষে স্থির হইল। এই মহাপাপমন্ত্রণার কলঙ্কটা কৃষ্ণের স্কন্ধে অর্পিত হইয়াছে। তিনিই ইহার প্রবর্তক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। কৃষ্ণ বলিতেছেন,
“হে পাণ্ডবগণ! অন্যের কথা দূরে থাকুক, সাক্ষাৎ দেবরাজ ইন্দ্রকে দ্রোণাচার্যকে সংগ্রামে পরাজয় করিতে সমর্থ নহেন। কিন্তু উনি অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিলে মনুষ্যেরাও তাঁহার বিনাশ করিতে পারে, অতএব তোমরা ধর্ম পরিত্যাগপূর্বক উঁহারে পরাজয় করিবার চেষ্টা কর।”
আর পাতা দশ বার পূর্বে যাঁহার মুখে কবি এই বাক্য সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন,
“আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে, যে স্থানে ব্রহ্ম, সত্য, দম, শৌচ, ধর্ম, শ্রী, লজ্জা, ক্ষমা, ধৈর্য অবস্থান করে, আমি সেইখানেই অবস্থান করি।”*
* ঘটোৎকচবধ-পর্বাধ্যায়, ১৮২ অধ্যায়।