“শুনিতেছি, দুর্যোধন প্রভৃতি সকলে ক্রুদ্ধ হইয়া আমাকে বলপূর্বক নিগৃহীত করিবেন। কিন্তু আপনি অনুমতি করিয়া দেখুন, আমি ইঁহাদিগকে আক্রমণ করি, কি ইঁহারা আমাকে আক্রমণ করেন। আমার এরূপ সামর্থ্য আছে, যে আমি একাকী ইঁহাদিগকে সকলকে নিগৃহীত করিতে পারি। কিন্তু আমি কোন প্রকারেই নিন্দিত পাপজনক কর্ম করিব না। আপনার পুত্রেরাই পাণ্ডবগণের অর্থে লোলুপ হইয়া স্বার্থভ্রষ্ট হইবেন। বস্তুতঃ ইঁহারা আমাকে নিগৃহীত করিতে ইচ্ছা করিয়া যুধিষ্ঠিরকে কৃতকার্য করিতেছেন। আমি অদ্যই ইঁহাদিগকে ও ইঁহাদিগের অনুচরগণকে নিগ্রহণ করিয়া পাণ্ডবগণকে প্রদান করিতে পারি। তাহাতে আমাকে পাপভাগী হইতেও হয় না। কিন্তু আপনার সন্নিধানে ঈদৃশ ক্রোধ ও পাপবুদ্ধিজনিত গর্হিত কার্যে প্রবৃত্ত হইব না। আমি অনুজ্ঞা করিতেছি যে, দুর্নীতিপরায়ণগণ দুর্যোধনের ইচ্ছানুসারে কার্য করুক।”*

এই কথার পর ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে ডাকাইয়া আনাইলেন, এবং তাঁহাকে অতিশয় কটূক্তি করিয়া ভর্ৎসনা করিলেন। বলিলেন,

“তুমি অতি নৃশংস, পাপাত্মা ও নীচাশয়; এই নিমিত্তই অসাধ্য, অযশস্কর, সাধুবিগর্হিত, পাপাচরণে সমুৎসুক হইয়াছ। কুলপাংশুল মূঢ়ের ন্যায় দুরাত্মাদিগের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত দুর্ধর্ষ জনার্দনকে নিগ্রহ করিতে ইচ্ছা করিতেছ। যেমন বালক চন্দ্রমাকে গ্রহণ করিতে উৎসুক হয়, তুমিও সেইরূপ ইন্দ্রাদি দেবগণের দুরাক্রম্য কেশবকে গ্রহণ করিবার বাসনা করিতেছ। দেব, মনুষ্য, গন্ধর্ব, অসুর ও উরগগণ যাঁহার সংগ্রাম সহ্য করিতে সমর্থ হয় না; তুমি কি, সেই কেশবের পরিচয় পাও নাই? বৎস! হস্তদ্বারা কখন বায়ু গ্রহণ করা যায় না; পাণিতল দ্বারা কখন পাবক স্পর্শ করা যায় না; মস্তক দ্বারা কখন মেদিনী ধারণ করা যায় না; এবং বলদ্বারাও কখন কেশবকে গ্রহণ করা যায় না।”

* কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রকাশিত অনুবাদ প্রশংসিত, এ জন্য সচরাচর আমি মূলের সহিত অনুবাদ না মিলাইয়াই অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি। কিন্তু কৃষ্ণের এই উক্তিতে কিছু অসঙ্গতি ঐ অনুবাদে দেখা যায়, যথা, যে কার্যের জন্য পাপভাগী হইতে হয় না এক স্থানে বলিয়াছেন, সেই কার্যকে কয় ছত্র পরে পাপবুদ্ধিজনিত বলিতেছেন। এজন্য মূলের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলাম। মূলে তত অসঙ্গতি দেখা যায় না। মূল উদ্ধৃত করিতেছি
          রাজন্নেতে যদি ক্রুদ্ধা মাং নিগৃহ্নীয়ুরোজসা।
          এতে বা মামহং বৈনাননুজানীহি পার্থিব ||
          এতান্ হি সর্বান্ সংরদ্ধান্নিন্তুমহম্যূৎসহে।
          ন চাহং নিন্দিতং কর্ম কুর্যাং পাপং কথঞ্চন ||
          পাণ্ডবার্থে হি লুভ্যন্তঃ স্বার্থান্ হাস্যন্তি তে সুতাঃ।
          এতে চেদেবমিচ্ছন্তি কৃতকার্যো যুধিষ্ঠিরঃ ||
          অদ্যৈব হ্যহমেনাংশ্চ যে চৈনাননু ভারত।
          নিগৃহ্য রাজন্ পার্থেভ্যো দদ্যাং কিং দুষ্কৃতঃ ভবেৎ ||
          ইদন্তু ন প্রবর্তেয়ং নিন্দিতং কর্ম ভারত।
          সন্নিধৌ তে মহারাজ ক্রোধজং পাপবুদ্ধিজম্ ||
          এষ দুর্যোধনো রাজন্ যথেচ্ছতি তথাস্তু তৎ।
          অহন্ত সর্বাংস্তনয়াননুজানামি তে নৃপ ||

“কিং দুষ্কৃতং ভবেৎ” ইতি বাক্যের অর্থ ঠিক “পাপভাগী হইতে হয় না,” এমত নহে। কথার ভাব ইহাই বুঝা যাইতেছে যে, “দুর্যোধন আমাকে বদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছে; আমি যদি তাহাকে এখন বাঁধিয়া লইয়া যাই, তাহা হইলে কি এমন মন্দ কাজ হয়?” দুর্যোধনকে বদ্ধ করা মন্দ কাজ হয় না, কেন না, অনেকের হিতের জন্য একজনকে পরিত্যাগ করা শ্রেয় বলিয়া কৃষ্ণ স্বয়ংই ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়াছেন যে, ইহাকে বদ্ধ কর। তবে কৃষ্ণ এক্ষণে স্বয়ং এ কাজ করিলে ক্রোধবশতঃই তিনি ইহা করিতেছেন, ইহা বুঝাইবে। কেন না, এতক্ষণ তিনি নিজে তাহাকে বদ্ধ করিবার অভিপ্রায় করেন নাই। ক্রোধ যাহাতে প্রবর্তিত করে, তাহা পাপবুদ্ধিজনিত, সুতরাং আদর্শ পুরুষের পক্ষে নিন্দিত ও পরিহার্য কর্ম।