কৃষ্ণচরিত্র - চতুর্থ খণ্ড
বিস্ময়ের বিষয় এই যে, যিনি এইরূপ নিঃস্বার্থ আচরণ করিতেন, যিনি দুরবস্থাগ্রস্তমাত্রেরই হিতানুসন্ধান করা নিজ জীবনের ব্রতস্বরূপ করিয়াছিলেন, পাশ্চাত্ত্য মূর্খেরা এবং তাঁহাদের শিষ্যগণ সেই কৃষ্ণকে কুকর্মানুরত, দুরভিসন্ধিযুক্ত ক্রূর এবং পাপাচারী বলিয়া, স্থির করিয়াছেন। ঐতিহাসিক তত্ত্বের বিশ্লেষণের শক্তি বা তাহাতে শ্রদ্ধা এবং যত্ন না থাকিলে, এইরূপ ঘটাই সম্ভব। স্থূল কথা এই, যিনি আদর্শ মনুষ্য, তাঁহার অন্যান্য সদ্বৃত্তির ন্যায় প্রীতিবৃত্তিও পূর্ণবিকশিত ও স্ফূর্তিপ্রাপ্ত হওয়াই সম্ভব। শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরের প্রতি যে ব্যবহার করিলেন তাহা অনেকেরই পূর্ববর্ধিত সখ্যস্থলে করা সম্ভব। যুধিষ্ঠির কুটুম্ব; যদি কৃষ্ণের সঙ্গে পূর্ব হইতে তাঁহার আলাপ প্রণয় এবং আত্মীয়তা থাকিত, তাহা হইলে তিনি যে ব্যবহার করিলেন, তাহা কেবল ভদ্রজনোচিত বলিয়াই ক্ষান্ত হইতে পারিতাম—বেশী বলিবার অধিকার থাকিত না। কিন্তু যিনি অপরিচিত এবঞ্চ দরিদ্র ও হীনাবস্থাপন্ন কুটম্বকে খুঁজিয়া লইয়া, আপনার কার্য ক্ষতি করিয়া, তাহার উপকার করেন, তাঁহার প্রীতি আদর্শ প্রীতি। কৃষ্ণের এই কার্যটি ক্ষুদ্র কার্য বটে, কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কার্যেই মনুষ্যের চরিত্রের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। একটা মহৎ কার্য বদ্মায়েসেও চেষ্টাচরিত্র করিয়া করিতে পারে, এবং করিয়া থাকে। কিন্তু যাঁহার ছোট কাজগুলিও ধর্মাত্মার পরিচায়ক, তিনি যথার্থ ধর্মাত্মা। তাই, আমরা মহাভারতের আলোচনায়ও* কৃষ্ণকৃত ছোট বড় সকল কার্যের সমালোচনার প্রবৃত্ত হইয়াছি। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা এ প্রণালীতে কখন কৃষ্ণকে বুঝিবার চেষ্টা করি নাই। তাহা না করিয়া কৃষ্ণচরিত্রের মধ্যে কেবল “অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ” এই কথাটি শিখিয়া রাখিয়াছি। অর্থাৎ যাহা সত্য এবং ঐতিহাসিক, তাহার কোন অনুসন্ধান না করিয়া, যাহা মিথ্যা এবং কল্পিত, তাহারই উপর নির্ভর করিয়া আছি। “অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ”# কথার ব্যাপারটা যে মিথ্যা, তাহা দ্রোণবধ—পর্বাধ্যায় সমালোচনাকালে আমরা প্রমাণীকৃত করিব।
বৈবাহিক পর্বে কৃষ্ণ সম্বন্ধে একটা তামাসার কথা ব্যাসোক্ত বলিয়া কথিত হইয়াছে। তাহা আমাদিগের সমালোচ্য বিষয়ের অন্তর্গত না হইলেও তাহার কিঞ্চিৎ উল্লেখ করা আবশ্যক বিবেচনা করিলাম। দ্রুপদরাজ, কন্যার পঞ্চ স্বামী হইবে শুনিয়া তাহাতে আপত্তি করিতেছেন। ব্যাস তাঁহার আপত্তি খণ্ডন করিতেছেন। খণ্ডনোপলক্ষে তিনি দ্রুপদকে একটি উপাখ্যান শ্রবণ করান। উপন্যাসটি বড় অদ্ভুত ব্যাপার। উহার স্থূল তাৎপর্য এই যে, ইন্দ্র একদা গঙ্গাজলে একটি রোরুদ্যমানা সুন্দরী দর্শন করেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, “তুমি কেন কাঁদিতেছ?” তাহাতে সুন্দরী উত্তর করে যে, “আইস, দেখাইতেছি।” এই বলিয়া সে ইন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া দেখাইয়া দিল যে, এক যুবা এক যুবতীর সঙ্গে পাশক্রীড়া করিতেছে। তাহারা ইন্দ্রের যথোচিত সম্মান না করায় ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হইলেন। কিন্তু যে যুবা পাশক্রীড়া করিতেছিলেন, তিনি স্বয়ং মহাদেব। ইন্দ্রকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া তিনিও ক্রুদ্ধ হইলেন এবং ইন্দ্রকে এক গর্তের ভিতর প্রবেশ করিতে বলিলেন। ইন্দ্র গর্তের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, সেখানে তাঁহার মত আর চারিটি ইন্দ্র আছেন! শেষ মহাদেব পাঁচ জন ইন্দ্রকে ডাকিয়া বলিলেন যে, “তোমরা গিয়া পৃথিবীতে মনুষ্য হও।” সেই ইন্দ্রেরাই আবার মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করিলেন যে, “ইন্দ্রাদি পঞ্চদেব গিয়া আমাদিগকে কোন মানুষীর গর্ভে উৎপন্ন করুন”!!! সেই পাঁচ জন ইন্দ্র ইন্দ্রাদির ঔরসে পঞ্চ পাণ্ডব হইলেন। বিনাপরাধে মেয়েটাকে মহাদেব হুকুম দিলেন যে, “তুমি গিয়া ইহাদিগের পত্নী হও।” সে দ্রৌপদী হইল। সে যে কেন কাঁদিয়াছিল, তাহার আর খবর নাই। অধিকতর রহস্যের বিষয় এই যে, নারায়ণ এই কথা শুনিবামাত্রই আপনার মাথা হইতে দুইগাছি চুল উপড়াইয়া ফেলিয়া দিলেন। একগাছি কাঁচা, একগাছি পাকা। পাকা-গাছটি বলরাম হইলেন, কাঁচা-গাছটি কৃষ্ণ হইলেন!!!
*হরিবংশ ও পুরাণ সকলে বিশ্বাসযোগ্য কথা পাওয়া যায় না বলিয়া পূর্বে ইহা পারি নাই।
# পরে দেখিব, “অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ” এই বুলিটাই মহাভারতে নাই। ইহা কথকঠাকুরের সংস্কৃত।
# পরে দেখিব, “অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ” এই বুলিটাই মহাভারতে নাই। ইহা কথকঠাকুরের সংস্কৃত।