প্রথম পরিচ্ছেদ—দ্রৌপদীস্বয়ংবর

মহাভারতের কৃষ্ণকথা যাহা আছে, তাহার কোন্ অংশ মৌলিক এবং বিশ্বাসযোগ্য, তাহার নির্বাচন জন্য প্রথম খণ্ডে যে সকল নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছি, এক্ষণে আমি পাঠককে সেই সকল স্মরণ করিতে অনুরোধ করি।

মহাভারতের কৃষ্ণকে প্রথম দ্রৌপদীস্বয়ংবরে দেখিতে পাই। আমার বিবেচনায় এই অংশের মৌলিকতায় সন্দিহান হইবার কারণ নাই। লাসেন্ সাহেব, দ্রৌপদীকে পাঞ্চালের পঞ্চ জাতির একীকরণস্বরূপ পাঞ্চালী বলিয়া, দ্রৌপদীর মানবীত্ব উড়াইয়া দিয়াছেন, ইহা পূর্বে বলিয়াছি। আমিও বিশ্বাস করি না যে, যজ্ঞের অগ্নি হইতে দ্রুপদ কন্যা পাইয়াছিলেন, অথবা সেই কন্যার পাঁচটি স্বামী ছিল। তবে দ্রুপদের ঔরসকন্যা থাকা অসম্ভব নহে, এবং তাহার স্বয়ংবর বিবাহ হইয়াছিল, এবং সেই স্বয়ংবরে অর্জুন লক্ষ্যবেধ করিয়াছিলেন, ইহা অবিশ্বাস করিবার কারণ নাই। তার পর, তাঁহার পাঁচ স্বামী হইয়াছিল, কি এক স্বামী হইয়াছিল, সে কথার মীমাংসায় আমাদের কোন প্রয়োজন নাই।*

কৃষ্ণকে মহাভারতে প্রথম দ্রৌপদীস্বয়ংবরে দেখি। সেখানে তাঁহার দেবত্ব কিছুই সূচিত হয় নাই। অন্যান্য ক্ষত্রিয়দিগের ন্যায় তিনি ও অন্যান্য যাদবেরা নিমন্ত্রিত হইয়া পাঞ্চালে আসিয়াছিলেন, তবে অন্যান্য ক্ষত্রিয়েরা দ্রৌপদীর আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ্যভেধে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, কিন্তু যাদবেরা কেহই সে চেষ্টা করে নাই।

পাণ্ডবেরা এই সভায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। কিন্তু নিমন্ত্রিত হইয়া নহে। দুর্যোধন তাঁহাদিগের প্রাণহানি করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহারা আত্মরক্ষার্থে ছদ্মবেশে বনে বনে ভ্রমণ করিতেছিলেন। এক্ষণে দ্রৌপদীস্বয়ংবরের কথা শুনিয়া ছদ্মবেশে এখানে উপস্থিত।

এই সমবেত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-মণ্ডল মধ্যে কেবল কৃষ্ণই ছদ্মবেশযুক্ত পাণ্ডবদিগকে চিনিয়াছিলেন। ইহা যে তিনি দৈবশক্তির প্রভাবে জানিতে পারিয়াছিলেন, এমন ইঙ্গিত মাত্র নাই। মনুষ্যবুদ্ধিতেই তাহা বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার উক্তিতেই ইহা প্রকাশ। তিনি বলদেবকে বলিতেছেন, “মহাশয়! যিনি এই বিস্তীর্ণ শরাসন আকর্ষণ করিতেছেন, ইনিই অর্জুন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। আর যিনি বাহুবলে বৃক্ষ উৎপাটনপূর্বক নির্ভয়ে রাজমণ্ডলে প্রবিষ্ট হইতেছেন, ইঁহার নাম বৃকোদর। ইত্যাদি। ইহার পরে সাক্ষাৎ হইলে যখন তাঁহাকে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “কি প্রকারে তুমি আমাদিগকে চিনিলে?” তাহাতে তিনি উত্তর

করিয়াছিলেন, “ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি কি লুকান থাকে?” পাণ্ডবদিগকে সেই ছদ্মবেশে চিনিতে পারা অতি কঠিন, আর কেহ যে চিনিতে পারে নাই, তাহা বিস্ময়কর নহে, কৃষ্ণ যে চিনিতে পারিয়াছিলেন— স্বাভাবিক মানুষবুদ্ধিতেই চিনিয়াছিলেন— ইহাতে কেবল ইহাই বুঝায় যে, অন্যান্য মনুষ্যাপেক্ষা তিনি তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছিলেন। মহাভারতকার এ কথাটা কোথাও পরিষ্কার করিয়া বলেন নাই, কিন্তু কৃষ্ণের কার্যে সর্বত্র দেখিতে পাই যে, তিনি মনুষ্যবুদ্ধিতে কার্য করেন বটে, কিন্তু তিনি সর্বাপেক্ষা তীক্ষ্ণবুদ্ধি মনুষ্য। এই বুদ্ধিতে কোথাও ছিদ্র দেখা যায় না। অন্যান্য বৃত্তির ন্যায় তিনি বুদ্ধিতেও আদর্শ মনুষ্য।

* পূর্বে বলিয়াছি যে, মহাভারতের পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, অনুক্রমণিকাধ্যায়ে ব্যাসদেব ১৫০ শ্লোকে মহাভারতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রচিত করিয়াছেন। ঐ অনুক্রমণিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণে দ্রৌপদীস্বয়ংবরের কথা আছে, কিন্তু পঞ্চ পাণ্ডবের সঙ্গে যে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল, এমন কথা নাই। অর্জুনই তাঁহাকে লাভ করিয়াছিলেন, এই কথাই আছে।

“সমবায়ে ততো রাজ্ঞং কন্যাং ভর্ত্বস্বয়ংবরাম্।

প্রাপ্তবানর্জুনঃ কৃষ্ণাং কৃত্বা কর্ম সুদুষ্করম্ ||” ১২৫ ||