অনন্তর অর্জুন লক্ষ্য বিঁধিলে সমাগত রাজাদিগের সঙ্গে তাঁহার বড় বিবাদ বাধিল। অর্জুন ভিক্ষুকব্রাহ্মণবেশধারী। একজন ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ বড় বড় রাজাদিগের মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া যাইবে, ইহা তাঁহাদিগের সহ্য হইল না। তাঁহারা অর্জুনের উপর আক্রমণ করিলেন। যত দূর যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহাতে অর্জুনই জয়ী হইয়াছিলেন। এই বিবাদ কৃষ্ণের কথায় নিবারণ হইয়াছিল। মহাভারতে এইটুকু কৃষ্ণের প্রথম কাজ। তিনি কি প্রকারে বিবাদ মিটাইয়াছিলেন, সেই কথাটা বলাই আমাদের উদ্দেশ্য। বিবাদ মিটাইবার অনেক উপায় ছিল। তিনি নিজে বিখ্যাত বীরপুরুষ, এবং বলদেব, সাত্যধিক প্রভৃতি অদ্বিতীয় বীরেরা তাঁহার সহায় ছিল। অর্জুন তাঁহার আত্মীয়—পিতৃষ্বসার পুত্র। তিনি যাদবদিগকে লইয়া সমরক্ষেত্রে অর্জুনের সাহায্যে নামিলে, তখনই বিবাদ মিটাইয়া যাইতে পারিত। ভীম তাহাই করিয়াছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ আদর্শ ধার্মিক, যাহা বিনা যুদ্ধে সম্পন্ন হইতে পারে, তাহার জন্য তিনি কখনও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন নাই। মহাভারতের কোন স্থানেই ইহা নাই যে, কৃষ্ণ ধর্মার্থ ভিন্ন অন্য কারণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। আত্মরক্ষার্থ ও পরের রক্ষার্থ যুদ্ধ ধর্ম, আত্মরক্ষার্থ বা পরের রক্ষার্থ যুদ্ধ না করা পরম অধর্ম। আমরা বাঙ্গালি জাতি, আজি সাত শত বৎসর সেই অধর্মের ফলভোগ করিতেছি। কৃষ্ণ কখনও অন্য কারণে যুদ্ধ করেন নাই। আর ধর্মস্থাপনজন্য তাঁহার যুদ্ধে আপত্তি ছিল না। যেখানে যুদ্ধ ভিন্ন ধর্মের উন্নতি নাই, সেখানেও যুদ্ধ না করাই অধর্ম। কেবল কাশীরাম দাস বা কথকঠাকুরদের কথিত মহাভারতে যাঁহাদের অধিকার, তাঁহাদের বিশ্বাস, কৃষ্ণই সকল যুদ্ধের মূল; কিন্তু মূল মহাভারত বুদ্ধিপূর্বক পড়িলে এরূপ বিশ্বাস থাকে না। তখন বুঝিতে পারা যায় যে, ধর্মার্থ ভিন্ন কৃষ্ণ কখনও কাহাকেও যুদ্ধে প্রবৃত্তি দেন নাই নিজেও ধর্মার্থ ভিন্ন যুদ্ধ করেন নাই।

এখানেও কৃষ্ণ যুদ্ধের কথা মনেও আনিলেন না। তিনি বিবদমান ভূপালবৃন্দকে বলিলেন, “ভূপালবৃন্দ! ইঁহারাই রাজকুমারীকে ধর্মতঃ লাভ করিয়াছিলেন, তোমরা ক্ষান্ত হও, আর যুদ্ধে প্রয়োজন নাই।” ‘ধর্মতঃ’! ধর্মের কথাটা ত এতক্ষণ কাহারও মনে পড়ে নাই। সে কালের অনেক ক্ষত্রিয় রাজা ধর্মভীত ছিলেন, রুচিপূর্বক কখন অধর্মে প্রবৃত্ত হইতেন না। কিন্তু এ সময়ে রাগান্ধ হইয়া ধর্মের কথাটা ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু যিনি প্রকৃত ধর্মাত্মা, ধর্মবুদ্ধিই যাঁহার জীবনের উদ্দেশ্য, তিনি এ বিষয়ের ধর্ম কোন্ পক্ষে, তাহা ভুলেন নাই। ধর্মবিস্মৃতদিগের ধর্মস্মরণ করিয়া দেওয়া, ধর্মানভিজ্ঞদিগকে ধর্ম বুঝাইয়া দেওয়াই, তাঁহার কাজ।

ভূপালবৃন্দকে কৃষ্ণ বলিলেন, “ইঁহারাই রাজকুমারীকে ধর্মতঃ লাভ করিয়াছিলেন, অতএব আর যুদ্ধে প্রয়োজন নাই।” শুনিয়া রাজারা নিরস্ত হইলেন। যুদ্ধ ফুরাইল। পাণ্ডবেরা আশ্রমে গেলেন।

এক্ষণে ইহা বুঝা যায় যে, যদি একজন বাজে লোক দৃপ্ত রাজগণকে ধর্মের কথাটা স্মরণ করিয়া দিত, তাহা হইলে দৃপ্ত রাজগণ কখনও যুদ্ধ হইতে বিরত হইতেন না। যিনি ধর্মের কথাটা স্মরণ করিয়া দিলেন, তিনি মহাবলশালী এবং গৌরবান্বিত। তিনি জ্ঞান, ধর্ম ও বাহুবলে সকলের প্রধান হইয়াছিলেন। সকল বৃত্তিগুলিই সম্পূর্ণরূপে অনুশীলিত করিয়াছিলেন, তাহারই ফল এই প্রাধান্য। সকল বৃত্তিগুলি অনুশীলিত না হইলে, কেহই তাদৃশ ফলদায়িনী হয় না। এইরূপ কৃষ্ণচরিত্রের দ্বারা ধর্মতত্ত্ব পরিস্ফুট হইতেছে।