মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত
প্রথম। সেই মিষ্ট কথা। একবার তিনি কমিশনার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। সাহেব তখন মেমসাহেবের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া গরমমেজাজ ছিলেন, এতেলা হইবামাত্র বলিলেন, “নেকাল দেও শালাকো |” বাহির হইতে মুচিরাম শুনিতে পাইয়া সেইখান হইতে দুই হাতে সেলাম করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব হুজুর। হামারা বহিনকো খোদা জিতা রাখে |”
দ্বিতীয়। মুচিরাম ডিপুটির হাতে প্রায় হপ্তম পঞ্জমের কাজ ছিল-অন্য কাজ বড় ছিল না। হপ্তম পঞ্জমের মোকদ্দমায় একে সহজেই বড় বিচার আচারের প্রয়োজন হইত না-তাতে আবার মুচিরাম বিচার আচারের বড় ধার ধারিতেন না-চোখ বুজিয়া ডিক্রী দিতেন-নথির কাগজও বড় পড়িতেন না। সুতরাং মাস্কাবার দেখিয়া সাহেবরা ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। জনরব যে, মুচিরামের একেবারে হঠাৎ সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীতে পদবৃদ্ধি হইবে। কতকগুলো চেঙ্গড়া ছোঁড়া শুনিয়া বলিল, “আরও পদবৃদ্ধি? ছটা পা হবে না কি?”
দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সময়ে চট্টগ্রামের কালেক্টরীতে কিছু গোলযোগ উপস্থিত হইল। গোল মিটাইবার জন্য সেখানকার কমিশ্যনার একজন ভারি বিচক্ষণ ডিপুটি কালেক্টর পাইবার প্রার্থনা করিলেন। বোর্ড বলিলেন-বিচক্ষণ ডিপুটি? সে ত মুচিরাম ভিন্ন আর কাহাকে দেখি না-তাহাকেই চট্টগ্রাম পাঠান হৌক। গবর্ণমেণ্ট সেই কথা মঞ্জুর করিয়া মুচিরামকে চাটিগাঁ বদলি করিলেন।
সম্বাদ পাইয়া মুচিরাম বলিলেন, এইবার চাকরি ছাড়িতে হইল। তাঁহার শোনা ছিল, চাটিগাঁ গেলেই লোকে জ্বর প্লীহা হইয়া মরিয়া যায়। আরও শোনা ছিল যে, চাটিগাঁ যাইতে সমুদ্র পার হইতে হয়-এক দিন এক রাত্রের পাড়ি। সুতরাং চাটিগাঁ যাওয়া কি প্রকারে হইতে পারে? বিশেষ ভদ্রকালী-ভদ্রকালী এখন পূর্ণযৌবনা-সে বলিল, “আমি কোন মতেই চাটিগাঁ যাইব না-কি তোমায় যাইতে দিব না। তুমি যদি যাও, তবে আমি বিষ খাইব |” এই বলিয়া ভদ্রকালী একটা বড় খোরা লইয়া তেঁতুল গুলিতে বসিলেন। ভদ্রকালী তেঁতুল ভালবাসিতেন-মুচিরাম বলিতেন, “ওতে ভারি অম্বল হয়-ও বিষ |” তাই ভদ্রকালী তেঁতুল গুলিতে বসিলেন-মুচিরাম হাঁ হাঁ করিয়া নিষেধ করিতে লাগিলেন-ভদ্রকালী তাহা না শুনিয়া “বিষ খাইব” বলিয়া সেই তেঁতুলগোলায় লবণ ও শর্করা সংযোগপূর্ব্বক আধ সের চাউলের অন্ন মাখিয়া লইলেন। মুচিরাম অশ্রুপূর্ণলোচনে শপথ করিলেন যে, তিনি কখনই চাটিগাঁ যাইবেন না। ভদ্রকালী কিছুতেই শুনিল না-সমুদায় তেঁতুলমাখা ভাতগুলি খাইয়া বিষপান-কার্য্য সমাধা করিল। মুচিরাম তৎক্ষণাৎ চাকরিতে ইস্তেফা পাঠাইয়া দিলেন।
স্থূল কথা, মুচিরামের জমীদারীর আয় এত বৃদ্ধি হইয়াছিল যে, ডিপুটিগিরির সামান্য বেতন, তাঁহার ধর্ত্তব্যের মধ্যে ছিল না। সুতরাং সহজে চাকরি ছাড়িয়া দিলেন।