মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত
সাহেব প্রথম আসিয়া, মুচিরামের কালোকালো নধর সুচিক্কণ শরীরটি দেখিয়া, এবং তাহার আভূমিপ্রণত ডবল সেলাম দেখিয়া নিজের সরলচিত্তে একেবারে সিদ্ধান্ত করিলেন যে, আপিসের মধ্যে এই সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক। সে বিশ্বাস তাঁহার কিছুতেই গেল না। যাইবারও কোন কারণ ছিল না–কেন না, কাজকর্ম্মের তিনি খবর রাখিতেন না। একদিন আপিসের মীর মুন্সী মিরজা গোলাম সর্ফদর খাঁ সাহেব, দুনিয়াদারি নামাফিক মনে করিয়া ফৌত করিলেন। সাহেব পরদিনেই মুচিরামকে ডাকিয়া তৎপদে অভিষিক্ত করিলেন। মীর মুন্সীর বেতন কুড়ি টাকা-কিন্তু বেতনে কি করে? পদটি রুধিরে পরিপ্লুত। অজরামরবৎপ্রাজ্ঞ মুচিরাম শর্ম্মা রুধিরসঞ্চয় করিতে লাগিলেন।
দোষ কি? অজরামরবৎপ্রাজ্ঞ বিদ্যামর্থঞ্চ চিন্তয়েৎ। দুইটা একজনে পারে না-মুচিরাম বিদ্যাচিন্তা করিতে সক্ষম নহেন; কোষ্ঠীতে তাহা লেখে নাই-অতএব
বিষ্ণুশর্ম্মার উপদেশানুসারে মৃত্যুভয় রহিত হইয়া তিনি অর্থচিন্তায় প্রবৃত্ত। যদি সেই “হিতোপদেশ”গুলি অধীত হইবার যোগ্য হয়-যদি সে গ্রন্থ এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও পূজার যোগ্য হয়-তবে মুচিরামও প্রাজ্ঞ-আর এ দেশের সকল মুচিই প্রাজ্ঞ।
বিষ্ণুশর্ম্মা ভারতবর্ষের মাকিয়াবেল্লি-চাণক্য ভারতের রোশফুকল। যাহার এইরূপ গ্রন্থ বিদ্যালয়ের বালকদিগকে পড়াইবার নিয়ম করিয়াছে, তাহাদিগের উচিত, আবার বিদ্যালয়ের প্রবেশ করা। তাহাদের শিক্ষা হয় নাই।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
মুচিরাম দুই তিন বৎসর মীর মুন্সীগিরি করিল-তার পর কালেক্টরীর পেস্কারি খালি হইল। পেস্কারিতে বেতন পঞ্চাশ টাকা-আর উপার্জ্জনের ত কথাই নাই। মুচিরাম ভাবিল, কপাল ঠুকিয়া একখানা দরখাস্ত করিব।
তখন কালেক্টর ও ম্যাজিষ্ট্রেট পৃথক্ পৃথক্ ব্যক্তি হইত। সেখানে সে সময়ে হোম নামা এক সাহেব কালেক্টর ছিলেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান্ ও কর্ম্মঠ লোক ছিলেন, কিন্তু একটা দোষ ছিল-কিছু মিষ্ট কথার বশ।
মুচিরাম একখানি ইংরেজি দরখাস্ত লিখাইয়া লইল-মুচিরামের নিজবিদ্যা দরখাস্ত পর্য্যন্ত কুলায় না। যে দরখাস্ত লিখিল, মুচিরাম তাহাকে বলিয়া দিলেন, “দেখিও যেন ভাল ইংরেজি না হয়। আর যা হৌক না হৌক, দরখাস্তের ভিতর যেন গোটা কুড়ি ‘মাই লার্ড’ আর ‘ইওর লার্ডশিপ’ থাকে |” লিপিকার সেই রকম দরখাস্ত লিখিয়া দিল। তখন শ্রীমুচিরাম বেশভূষায় প্রবৃত্ত হইলেন। আপনার চারখানির ঢিলা পায়জামা পরিত্যাগ করিয়া, থানের ধুতি শ্রীঅঙ্গে পরিধান করিলেন; চুড়িদার আস্তীন আল্পাকার চাপকান পরিত্যাগ করিয়া, পূর্ব্বক, বুকফাঁক বন্ধকওয়ালা ঢিলা আস্তীন লাংক্লথের চাপকান গ্রহণ করিলেন। লাটুদার পাগড়ি ফেলিয়া দিয়া, স্বহস্তে মাথায় বিড়া জড়াইলেন; এবং চাঁদনির আম্দানি নূতন চক্চকে জুতা ত্যাগ করিয়া চটিতে চারুচরণদ্বয় মণ্ডন করিলেন। ইতিপূর্ব্বে গঙ্গারাম সাহেবকে হরিয়েক রকম সেলাম করিয়া, কাঁদো কাঁদো মুখ করিয়া, একখানা সুপারিস চিঠি বাহির করিয়া লইয়াছিলেন। এইরূপ চিঠি, দরখাস্ত ও বিহিত সজ্জাসহিত সেই শ্রীমুচিরামচন্দ্র, যথায় হোম সাহেব এজলাসে বসিয়া দুনিয়া জলুস করিতেছিলেন, তথায় গিয়া দর্শন দিলেন।
রেল দেওয়া কাটরার ভিতর, উঁচুতে হোম সাহেব এজলাস করিতেছেন। চারি দিকে অনেক মাথায় পাগড়ি ঙ বসিয়াছে-লোকে কথা কহিলেই চাপরাশী বাবাজিউরা দাড়ি ঘুরাইয়া গালি দিতেছেন-একটা স্পানিয়েল টেবিলের নীচে শুইয়া, অর্থিগণের নয়নপথে লাঙ্গুল-শোভা বিকাশ করিতেছে-এক ফোঁটা গুড় পড়িলে যেমন সহস্র সহস্র পিপীলিকা তাহা বেষ্টন করে, খালি চাকরীটির মালিক হোম সাহেবকে তেমনি উমেদওয়ার ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাহেব উমেদওয়ারদিগের দরখাস্ত শুনিতেছেন। অনেক বড় বড় ইংরেজিনবীশ আসিয়াছেন-সেকেলে কেঁদো কেঁদো স্কলার্শিপ হোল্ডার। সাহেব তাঁহাদিগকে এক এক কথায় বিদায় করিলেন। “I dare say you are well up in Shakespeare and Milton and Bacon and so forth. Unfortunately we don’t want quotations from Shakespeare and Milton and Bacon in the office. It is not the most learned man who is best fitted for this kind of work. So you can go, Baboo.” অনেক শামলা মাথায় দিয়া, চেন ঝুলাইয়া, পরিপাটী বেশ করিয়া আসিয়াছিলেন, সাহেব দৃষ্টিমাত্র তাঁহাদিগকে বিদায় দিলেন। “You are very rich I see; I want a poor man who will work for his bread. You will throw up your place on the slightest quarrel. You can go.” শামলা চেনের দল, অভিমন্যুসম্মুখে কুরুসৈন্যের ন্যায় বিমুখ হইতে লাগিল। বাকি রহিল মুচিরাম, এবং তাহার সমকক্ষজনকয়-বানর। সাহেব মুচিরামের দরখাস্ত পড়িলেন-হাসিয়া বলিলেন, “Why do you call me, my Lord? I am not a Lord.”
মুচিরাম যোড়হাতে হিন্দীতে বলিল, “বান্দা কো মালুম থা কি হুজুর লার্ড- ঘরানা |”