এই গেল প্রথমাবস্থা। দ্বিতীয়াবস্থা ঋগ্বেদসংহিতার& ১০ মণ্ডলের ৯৫ সূক্তে। এখানে উর্বশী পুরুরবা আর অরণিকাষ্ঠ নহে; ইহারা নায়ক নাহিকা। পুরুরবা উর্বশীর বিরহশঙ্কিত। এই রূপকাবস্থা। রূপকে উর্বশী (৫ম ঋকে) বলিতেছেন, “হে পুরুরবা, তুমি প্রতিদিন আমাকে তিন বার রমণ করিতে।” যজ্ঞের তিনটি অগ্নি ইহার দ্বারা সূচিত হইতেছে।! পুরুরবাকে উর্বশী “ইলাপুত্র” বলিয়া সম্বোধন করিতেছে। ইলার শব্দের অর্থ পৃথিবী।$ পৃথিবীরই পুত্র অরণিকাষ্ঠ।

মহাভারতের পুরুরবা ঐতিহাসিক চন্দ্রবংশীয় রাজা। চন্দ্রের পুত্র বুধ, বুধের পুত্র ইলা, ইলার পুত্র পুরুরবা। উর্বশীর গর্ভে ইহার পুত্র হয়; ইহার পুত্র হয়; তাহার নাম আয়ু।* যজুর্মন্ত্র যাহা উপরে উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা দেখিলে পাঠক দেখিতে পাইবেন, আয়ু সেই অরণিস্পৃষ্ট আজ্য। মহাভারতে এই আয়ুর পুত্র বিখ্যাত নহুষ। নুহুষের পুত্র বিখ্যাত যযাতি। যযাতির পুত্রের মধ্যে দুই জনের নাম যদু ও পুরু। যদু, যাদবদিগের আদিপুরুষ; পুরু, কুরুপাণ্ডবের আদিপুরুষ। এই তৃতীয়াবস্থা। তৃতীয়াবস্থায় অরণিকাষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্রাট্।

চতুর্থ অবস্থা, বিষ্ণু, পদ্ম প্রভৃতি পুরাণে। পুরাণ সকলে তৃতীয় অবস্থার ইতিহাস নূতন উপন্যাসে রঞ্জিত হইয়াছে, তাহার দুইটি নমুনা দিতেছি। একটি এই,—

উর্বশী ইন্দ্রসভায় নৃত্য করিতে করিতে মহারাজ পুরুরবাকে দেখিয়া মোহিত হওয়ায় নৃত্যের তালভঙ্গ হওয়াতে ইন্দ্রের অভিশাপের পঞ্চপঞ্চাশৎ বর্ষ স্বর্গভ্রষ্টা হইয়া পুরুরবার সহিত বাস করিয়াছিলেন।

আর একটি এইরূপ:—

পূর্বকালে কোন সময়ে ভগবান্ বিষ্ণু ধর্মপুত্র হইয়া গন্ধমাদন পর্বতে বিপুল তপস্যা করিয়াছিলেন। ইন্দ্র তাঁহার উগ্র তপস্যায় ভীত তাঁহার বিঘ্নার্থ কতিপয় অপ্সরার সহিত বসন্ত ও কামদেবকে প্রেরণ করেন। সেই সকল অপ্সরা যখন তাঁহার ধ্যানভঙ্গে অশক্তা হইল, তখন কামদেব অপ্সরাগণের উরু হইতে ইঁহাকে সৃজন করিলেন। ইনিই তাঁহার তপোভঙ্গে সমর্থা হন। ইহাতে ইন্দ্র অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং ইঁহার রূপে মোহিত হইয়া ইঁহাকে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিলেন। ইনিও সম্মতা হইলেন। পরে মিত্র ও বরুণ তাঁহাদিগকে ঐরূপ মনোভাব জ্ঞাপন করিলে ইনি প্রত্যাখ্যান করেন। তাহাতে তাঁহাদের শাপে ইনি মনুষ্যভোগ্যা (অর্থাৎ পুরুরবার পত্নী) হন।

এই সকল কথার আলোচনায় আমরা স্পষ্টই বুঝিতে পারি যে, যজুর্বেদসংহিতার ৫ অধ্যায়ের সেই মন্ত্রগুলি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। তাহার পর, ঋগ্বেদসংহিতার দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্ত। তারপর মহাভারত। তারপর পদ্মাদি পুরাণ।

আমরা যে সকল গ্রন্থের উপর নির্ভর করিয়া কৃষ্ণচরিত্র বুঝিতে চেষ্টা করিব তাহারও পৌর্বাপর্য এই নিয়মের অনুবর্তী হইয়া নির্ধারিত করা যাইতে পারে। দুই একটা উদাহরণের দ্বারা ইহা বুঝাইতেছি।

& সাহেবেরা বলেন, ঋগ্বেদসংহিতা আর সকল সংহিতা হইতে প্রাচীন। ইহার অর্থ এমন নয় যে, ঋক্‌সংহিতার সকল সূক্তগুলি সাম ও যজুঃসংহিতার সকল মন্ত্র হইতে প্রাচীন। যদি এ অর্থে এ কথা কেহ বলিয়া থাকেন বা বুঝিয়া থাকেন, তবে তিনি অতিশয় ভ্রান্ত। এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, ঋক্‌সংহিতায় এমন কতকগুলি সূক্ত আছে যে, সেগুলি সকল বেদমন্ত্র অপেক্ষা প্রাচীন। নচেৎ যে, ঋক্‌সংহিতায় এমন অনেক পাওয়া যায় যে, তাহা স্পষ্টতঃ আধুনিক বলিয়া সাহেবেরাই স্বীকার করেন। অনেকগুলি ঋক্ সামবেদসংহিতাতেও আছে ঋগ্বেদসংহিতাতেও আছে। সংহিতা কেহ কাহারও অপেক্ষা প্রাচীন নহে, তবে কোন মন্ত্র অন্য মন্ত্রের অপেক্ষা প্রাচীন। এরূপ প্রাচীন মন্ত্র ঋক্‌সংহিতায় বেশী আছে কিন্তু ঋক্‌ সংহিতায় এমন অনেক মন্ত্রও আছে যে, তাহা যজুঃ সামের অনেক মন্ত্রের অপেক্ষা আধুনিক। দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্ত ইহার একটি উদাহরণ।
! মক্ষমূলর প্রভৃতি এই রূপকের অর্থ করেন, উর্বশী ঊষা, পুরুরবা সূর্য। Solar myth এই পণ্ডিতেরা কোন মতেই ছাড়িতে পারেন না। যজুর্মন্ত্র যাহা উদ্ধৃত করিলাম, তাহাতে এবং তিন বার সংসর্গের কথায় পাঠক বুঝিবেন যে, এই রূপকের প্রকৃত অর্থ উপরে লিখিত হইল।
$ সর্পমাংসাৎ পশু ব্যাড়ৌ গোভূবাচস্ত্বিড়া ইলা ইত্যমরঃ।
* কখন কখন এই নাম “আয়ু” লিখিত হইয়াছে।