দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স রাজ্যের যে অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা বর্ণনীয় নহে। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মধ্যে তাহার বর্ণনার স্থান নাই–প্রয়োজন নাই। জগদ্বিখ্যাত, বাক্যবিশারদ, পুরাবৃত্তজ্ঞ, সূক্ষ্মদর্শী বহুসংখ্যক লেখক তাহার পুঞ্জ পুঞ্জ বর্ণনা করিয়াছেন; সেই সকল বর্ণনা সকলেরই অনায়াসপাঠ্য। দুই একটা কথা বলিলেই আমাদিগের উদ্দেশ্য সাধন হইবে।

কার্লাইল ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়াছেন যে, “যে আইন অনুসারে একজন ভূমধ্যকারী মৃগয়া হইতে আসিয়া দুই জন দাস বধ করিয়া তাহাদিগের রক্তে পদ প্রক্ষালন করিতে পারিতেন, সে আইন ইদানীং আর প্রচলিত ছিল না।” ইদানীং প্রচলিত ছিল না! তবে পূর্বে ছিল! “পঞ্চাশৎ-বৎসরমধ্যে শারলোয়ার ন্যায় কোন ব্যক্তি স্থপতিদিগকে গুলি করিয়া তাহারা কি প্রকারে ছাদের উপর হইতে গড়াইয়া পড়ে, দেখিয়া আনন্দ লাভ করে না।” সেরাজউদ্দৌল্লা দেশের অধিপতি ছিলেন; শারলোয়া উচ্চশ্রেণীর প্রজা মাত্র।

এই ব্যঙ্গোক্তিতেই তাৎকালিক ফরাসীদিগের মধ্যে কি অচিন্তনীয় বৈষম্য জন্মিয়াছিল, তাহা বুঝা যাইবে। পঞ্চদশ লুই প্রমোদানুরক্ত, বৃথাভোগাসক্ত, ব্যয়শৌণ্ড, স্বার্থপর রাজা ছিলেন। তাঁহার উপপত্নীগণের পরিতুষ্টির জন্য অনন্ত ধনরাশির আবশ্যক। মাদাম পোম্পাদুর ও মাদাম দুবারি যে ঐশ্বর্য ভোগ করিয়াছিলেন, তাহা পরিণীতা রাজমহিষীর নিষ্কলঙ্ক কপালেও ঘটে না। মাদাম দুবারির একটি বানরবৎ কাফ্রি খানসামা ছিল; সে এক স্থানে শাসনকর্তৃত্বপদে নিযুক্ত হইয়াছিল—মাদামের আজ্ঞা‌! লুইর বিলাসভবনের বর্ণনা শুনিলে ইন্দ্রপ্রস্থের দৈবশক্তিনির্মিতা পাণ্ডবীয়া পুরীর সঙ্গে তুলনা করা যায়—সেই সকল প্রমোদমন্দিরে যে উৎসব হইত, কিসের সঙ্গে তাহার তুলনা করিব? জলবৎ অর্থব্যয়,—এদিকে রাজকোষ শূন্য! রাজকোষ শূন্য, এবং প্রজাবর্গমধ্যে অন্নাভাবে হাহাকার রব আকাশমধ্যে উঠিতেছিল। রাজকোষ শূন্য—প্রজামধ্যে অন্নাভাব, হাহাকার রব—তবে এ সভাপর্বের রাজসূয়, এ নন্দনকাননে ঐন্দ্র বিলাস—এ সকল অর্থসাধ্য ব্যাপার সম্পন্ন হয় কোথা হইতে? সেই অন্নাভাবপীড়িত প্রজার জীবনোপায় অপহরণ করিয়া। পিষ্টকে পেষণ করিয়া—শুষ্ককে শোষণ করিয়া, দগ্ধকে দাহন করিয়া দুবারি কুলকলঙ্কিনীর অলকদাম রত্নরাজিতে শোভিত হয়। আর বড় মানুষেরা? তাহারা এক কপর্দক রাজকোষে অর্পণ করে না—কেবল রাজপ্রসাদ ভোগ করে। রাজপ্রসাদ অজস্র, অনন্ত অপরিমিত—যে যত পায়, গ্রহণ করে, কেন না, তাহা পিষ্টপেষণলব্ধ। কিন্তু রাজপ্রসাদভোগীরা কপর্দক মাত্র রাজকোষে দেয় না। বড় মানুষে কর দেয় না, ধর্মযাজকেরা কর দেয় না, রাজপুরুষেরা কর দেয় না—কেবল দীন দুঃখী কৃষকেরা কর দেয়। তাহার উপর করসংগ্রাহকদিগের অত্যাচার। মিশালা বলেন, “কর আদায় এক প্রকার প্রণালীবদ্ধ যুদ্ধের ন্যায় ছিল। তাহার দ্বারা দুই লক্ষ নিষ্কর্মা ভূমিকে প্রপীড়িত করিত। এই পঙ্গপালের রাশি, সর্বগ্রাস, সর্বনাশ করিত। এই প্রকারে পরিশোষিত প্রজাদিগের নিকট আরও আদায় করিতে হইলে, সুতরাং নিষ্ঠুর রাজব্যবস্থা, ভয়ঙ্কর দণ্ডবিধি, নাবিক দাসত্ব, ফাঁসিকাঠ, পীড়নযন্ত্র প্রভৃতির আবশ্যক হইল।” রাজকর ইজারা বন্দোবস্ত ছিল; ইজারাদারের এমন অধিকার ছিল যে, শস্ত্রাঘাতাদির দ্বারা রাজস্ব আদায় করে। তাহারা তজ্জন্য প্রজাবধ পর্যন্ত করিত। এক দিকে রমোদ্যান, বনবিহার, নৃত্যগীত, পরস্ত্রীর সহিত প্রণয়, হাস্যপরিহাস, অনন্ত প্রমোদ, চিন্তাশূন্যতা;—আর এক দিকে দারিদ্র্য, অনাহার, পীড়া নিরপরাধে নাবিক দাসত্ব, ফাঁসিকাঠ, প্রাণবধ! পঞ্চদশ লুইর রাজ্যকালে ফ্রান্সদেশে এইরূপ গুরুতর বৈষম্য। এই বৈষম্য কদর্য, অপরিশুদ্ধ রাজশাসনপ্রণালীজনিত। রূসোর গুরুতর প্রহারে সেই রাজ্য ও রাজশাসনপ্রণালী ভগ্নমূল হইল। তাঁহার মানস শিষ্যেরা তাহা চূর্ণীকৃত করিল।