কেবল এই বৈষম্য নহে। সম্রাট্ স্বেচ্ছাচারী। তাঁহার ক্ষমতা ও প্রতাপের সীমা ছিল না। নীরো, নগরে অগ্নি লাগাইয়া বীণাবাদনপূর্বক রঙ্গ দেখিয়াছিলেন। কালিগুলা আপন অশ্বকে কনসলের পদে বরণ করিলেন। ইলিয়গেবলসের স্বেচ্ছাচারিতা বর্ণনা করিতে লজ্জা করে। যে হউক না কেন, যত বড় লোক হউন না কেন, সম্রাটের ইচ্ছামাত্রে তিনি বধ্য,—বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে, বিনা বিচারে, তিনি বধ্য। আবার সেই সম্রাট্‌কে বধ করিয়া অন্যকে রাজা করে। রোমক সাম্রাজ্য তাহারা আলু পটলের মত ক্রয় বিক্রয় করে। রোমকে তাহারা যাহা মনে করে, তাহাই করে। সুবায় সুবাদারেরা স্বেচ্ছাচারী। যাহার শক্তি আছে, সেই স্বেচ্ছাচারী। যেখানে স্বেচ্ছাচার প্রবল, সেখানে বৈষম্যও প্রবল।

এই সময় খ্রীষ্টধর্ম রোমক সাম্রাজ্য মধ্যে প্রচারিত হইতে লাগিল। খ্রীষ্টের উচ্চারিত মহতী বাণী লোকের মর্মভেদ করিয়া প্রবেশ করিতে লাগিল। তিনি বলিয়াছিলেন, মনুষ্যে মনুষ্যে ভ্রাতৃসম্বন্ধ। সকল মনুষ্যই ঈশ্বরসমক্ষে তুল্য। বরং যে পীড়িত, দুঃখী, কাতর, সেই ঈশ্বরের অধিক প্রিয়। এই মহাবাক্যে বড় মানুষের গর্ব খর্ব হইল–প্রভুর গর্ব খর্ব হইল–অঙ্গহীন ভিক্ষুকও সম্রাটের অপেক্ষা বড় হইল। তিনি বলিয়াছিলেন, ইহলোকে আমার রাজত্ব নহে–ঐহিক সুখ সুখ নহে–ঐহিক প্রাধান্য প্রাধান্য নহে। পৃথিবীতে দুইবার দুইটি বাক্য উক্ত হইয়াছে,—তাহাই নীতিশাস্ত্রের সার–তদতিরিক্ত নীতি আর কিছুই নাই। একবার আর্যবংশীয় ব্রাহ্মণ গঙ্গাতীরে বলিয়াছিলেন, “আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ”। দ্বিতীয়বার জেরুসলেমের পর্বতশিখরে দাঁড়াইয়া য়ীহুদাবংশীয় যীশু বলিলেন, “অন্যের নিকট তুমি যে ব্যবহারের কামনা কর, অন্যের প্রতি তুমি সেই ব্যবহার করিও”। এই দুইটি বাক্যের ন্যায় মহৎ বাক্য ভূমণ্ডলে আর কখন উক্ত হইয়াছে কি না সন্দেহ। এই বাক্য সাম্যতত্ত্বের মূল।

এই সকল তত্ত্ব ধর্মশাস্ত্রোক্তি বলিয়া পরিগৃহীত হইতে লাগিলে, দাসের বন্ধনশৃঙ্খল মোচন হইতে লাগিল। ভোগাবিলাষী ভোগাবিলাষ ত্যাগ করিতে লাগিল। তৎপ্রসাদে রোমকে বর্বরে মিলিত হইয়া, মহাতেজস্বী, উন্নতিশীল, যুদ্ধদুর্মদ জাতি সঞ্জাত হইল। তাহারাই আধুনিক ইউরোপীয়দিগের পূর্বপুরুষ। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার ন্যায় লৌকিক উন্নতি পৃথিবীতে কখন হয় নাই বা হইবে এমত ভরসা পূর্বগামী মনুষ্যেরা কখন করেন নাই। ইহা যে কেবল খ্রীষ্ট ধর্মের ফল, এমত নহে; ইহার অনেক কারণ আছে–কিন্তু প্রধান কারণ খ্রীষ্টীয় নীতি এবং গ্রীক্ সাহিত্য এবং দর্শন। এবং খ্রীষ্ট ধর্মে যে কেবল সুফলই ফলিয়াছে, এমত নহে। ইষ্ট এবং অনিষ্ট উভয়বিধ ফলই ফলিয়াছিল। খ্রীষ্ট ধর্ম সাম্যাত্মক হইলেও পরিণামে তৎফলে একটি গুরুতর বৈষম্য জন্মিয়াছিল। ধর্মযাজকদিগের অত্যন্ত প্রভুত্ব বৃদ্ধি হইয়াছিল। স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি কয়েকটি ইউরোপীয় রাজ্যে এই বৈষম্য বড় গুরুতর হইয়াছিল! বিশেষ ফ্রান্সে তৎসহিত উচ্চশ্রেণী এবং অধঃশ্রেণীর মধ্যে ঈদৃশ গুরুতর বৈষম্য জন্মিয়াছিল যে, সেই বৈষম্যের ফলে ফরাসী মহাবিপ্লব ঘটিয়াছিল। সেই মথিত সাগরের একজন মন্থনকর্তা ছিলেন–তিনিই তৃতীয় বারের সাম্যতত্ত্ব প্রচারকর্তা। তৃতীয় সাম্যাবতার রূসো।