বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - বাঙ্গালীর উৎপত্তি
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে, “অন্ধ্রা পুণ্ড্রা সবরা পুলিন্দা মুতিবা ইত্যুদন্তা বহবো ভবন্তি।” মহাভারতেও এই পুণ্ড্রদিগের কথা আছে। সভাপর্ব্বে আছে যে, ভীম দিগ্বিজয়ে আসিয়া পুণ্ড্রাধিপতি বাসুদেব এবং কৌশকিকচ্ছবাসী মনৌজা রাজা, এই দুই মহাবলপরাক্রান্ত বীরকে পরাজয় করিয়া বঙ্গরাজের প্রতি ধাবমান হইলেন। বঙ্গ আধুনিক বাঙ্গালার পূর্ব্বভাগকে বলিত। এখনও সাধারণ লোকে সেই প্রদেশকেই বঙ্গদেশ বলে। ভীম পশ্চিম হইতে আসিয়া যে দেশ জয় করিয়া বাঙ্গালার পূর্ব্বভাগে প্রবেশ করিলেন, সে দেশ অবশ্য বাঙ্গলার পশ্চিমভাগে। উইল্সন্ সাহেবও স্বকৃত বিষ্ণুপুরাণানুবাদে ভারতবর্ষের ভৌগোলিক তত্ত্ব নিরূপণকালে বাঙ্গালার পশ্চিমাংশেই পুণ্ড্রজাতিকে সংস্থাপন করিয়াছেন।* তারপর খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে হিয়েন্থ্ সাঙ্ নামক চীন পরিব্রাজক এ প্রদেশে আসিয়া পুণ্ড্রদিগের রাজধানী পৌণ্ড্র বর্দ্ধন দেখিয়া গিয়াছেন। জেনারেল্ কানিংহাম্ সাহেব ঐ চীন পরিব্রাজকের লিখিত দিক্ ও দূরতা লইয়া পৌণ্ড্রবর্দ্ধন কোথায় ছিল, তাহা নিরূপণ করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন | তিনি কিছু ইতস্ততঃ করিয়া আধুনিক পাবনাকে পৌণ্ড্রবর্দ্ধন বলিয়া স্থির করিয়াছেন। পাবনা না হইয়া বাঙ্গালার প্রাচীন রাজধানী মালদহ জেলার অন্তর্গত ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী পাণ্ডুয়া বলিলে পৌণ্ড্রবর্দ্ধনের প্রকৃত সংস্থান ঘটিত। তারপর দশকুমারচরিতে লেখা আছে, “অনুজায় বিষাণবর্ম্মনে দণ্ডচক্রং চ পুণ্ড্রাভিযোগায় বিরোচেয়ং।” অর্থাৎ পুণ্ড্রদেশ আক্রমণের জন্য কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিষাণবর্ম্মাকে দণ্ড চক্র অর্থাৎ সৈন্যাদি দিতে ইচ্ছা করিয়াছি।# দশকুমারচরিত আধুনিক সংস্কৃত গ্রন্থ। উপরিলিখিত উক্তি কোন মৈথিল রাজার উক্তি, অতএব দশকুমার যখন প্রণীত হয়, তখনও পুণ্ড্রেরা মিথিলার নিকটবাসী।
* “Pundras the western Provinces of Bengal, or as sometimes used in a more comprehensive sense, it includes the following districts; Rajashahi, Dinagepore, and Rungpore; Nadiya, Beerbhoom, Burdwan, part of Midnapoor and the Jungle Mehals; Ramghur, Pacheti, Palamow, and part of Chunar. See an account of Pundra translated from what is said to be part of Brahmanda Section of the Bhavishyat Purana in the Quarterly Oriental Magazine, Decr. 1824. Wilson’s Vishnu Puranas.
আমাদিগের প্রিয়বন্ধু পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ভবিষ্যপুরাণখানি সন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন (ভবিষ্যপুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ নহে; ব্রহ্মাখণ্ড, ব্রহ্মাণ্ডখণ্ড নহে; এগুলি ছোট ছোট সাহেবী ভুল)। উহার এক কাপি সংস্কৃত কলেজে আছে। পুঁথিখানি খণ্ডিত; আসাম মণিপুর হইতে আরম্ভ করিয়া কাশী পর্য্যন্ত সমস্ত দেশের বিশেষ বিবরণ উহাতে দেওয়া আছে; কিন্তু গ্রন্থখানি পড়িয়া ভক্তি হয় না। গ্রন্থখানিতে বিদ্যাসুন্দরের গল্প আছে। মানসিংহ কর্ত্তৃক যশোহরের আক্রমণ বর্ণিত আছে। বিশেষ, গ্রন্থকারের বঙ্গদেশমধ্যে আসাম, চাট্টল এবং মণিপুর পর্য্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। এতদূর ত গ্রন্থের পরিচয় গেল। তাহাতে আছে যে, পৌণ্ড্রদেশ সাত ভাগে বিভক্ত;—গৌড়দেশ, বারেন্দ্রভূমি, নীবৃত, বরাহভূমি, বর্দ্ধমান, নারীখণ্ড ও বিন্ধ্যপার্শ্ব। এই সকল দেশের লোক দুষ্ট, চোর পরদারনিরত ইত্যাদি ইত্যাদি। গৌড়দেশের প্রধান নগরসমূহের মধ্যে মৌরসিধাবাদ (মুরশিদাবাদ নামের সংস্কৃত ফরম; মুরশিদাবাদ নামে ১৭০৪ সালে হয়, তাহার আগে উহাকে মুকশুধাবাদ বলিত বলিয়া ষ্টুয়ার্টের হিষ্টরি অব্ বেঙ্গলে উক্ত আছে;) সুতরাং গ্রন্থখানি ২০০ বৎসরের মধ্যে লিখিত বলিয়া বোধ হয়। গৌড়দেশে গৌড়নগরের উল্লেখ নাই। পাণ্ডুয়ারও উল্লেখ নাই। বরেন্দ্রভূমির প্রধান নগর পুট্টিলা, নটারো, চপলা (যেখানকার রাজা ব্রাহ্মণ), কাকমারী। নীবৃত দেশের প্রধান নগর কচ্ছপ, নসর, শ্রীরঙ্গপুর ও বিহার। রঙ্গপুরে বাগদী রাজা। নারীখণ্ডের প্রধান নগর বৈদ্যনাথ, দেবগড় করে, সোণামুখী ইত্যাদি। বরাহভূমের প্রধান নগর রঘুনাথপুর, ধবল ইত্যাদি। বর্দ্ধমানের প্রধান নগর বর্দ্ধমান, নবদ্বীপ, মায়াপুর, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি। বিন্ধ্যপার্শ্বের প্রধান নগর সুদর্শন, পুষ্পগ্রাম ও বদরী কুড়ক গ্রাম। এই সকল দেশের আচার ব্যবহার ও চতুঃসীমা আছে। আমাদের যতদূর মানচিত্র বোধ আছে, তাহাতে বোধ হয়, চতুঃসীমা অনেক ভজিবে না। গৌড়দেশের উত্তরে পদ্মাবতী ও দক্ষিণে বর্দ্ধমান। আসল গৌড়নগর ইহার মধ্যে পড়িল না।
উইল্সন্ সাহেব ঐ স্থলে আরও লিখিয়াছেন যে, রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে একচত্বারিংশৎ অধ্যায়ে দ্বাদশ শ্লোকে পুণ্ড্র দাক্ষিণাত্যে স্থাপিত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ঐ শ্লোকটি আমরা উদ্ধৃত করিতেছি—
“নদীং গোদাবরীং চৈব সর্ব্বমেবানুপশ্যতঃ।
তথৈবান্ধ্রাংশ্চ পুণ্ড্রাংশ্চ চোলান্ পাণ্ড্রাংশ্চ কেরলান্||”
# দশকুমারচরিত, তৃতীয় উচ্ছ্বাস।