পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, ককেশীয় ও মোঙ্গলীয় ভিন্ন আরও অনেক মনুষ্যজাতি আছে, তাহার মধ্যে কোন কোন জাতি স্বভাবতঃই অতিশয় কৃষ্ণবর্ণ। আফ্রিকার নিগ্রোরা ইহার উদাহরণ। কেবল রৌদ্রের উত্তাপে তাহারা এত কৃষ্ণবর্ণ, এমত নহে; যেমন তপ্ত দেশে কাফ্রির বাস আছে, তেমনি তপ্ত দেশে গৌরবর্ণ আর্য্য বা মোঙ্গলের বাস আছে। আমেরিকার যে প্রদেশে ইণ্ডিয়ানদিগের বর্ণ লোহিত, সেই প্রদেশেই সাক্সন্ বংশীয়দিগের বর্ণ গৌর; তিন শত বৎসরে কিছুমাত্র কৃষ্ণতাপ্রাপ্ত হয় নাই। ভারতবর্ষে এক প্রদেশেই শ্যামবর্ণ আর্য্যেরা এক মসীবর্ণ অনার্য্যেরা একত্র বাস করিতেছে। রৌদ্রসন্তাপে কতক দূর কৃষ্ণতা জন্মিতে পারে বটে। ভারতীয় আর্য্যদের তাহা কিছু দূর জন্মিয়াছে সন্দেহ নাই। তাহাদের মধ্যে কেহ গৌর, কেহ শ্যামল, কিন্তু বিন্ধ্যপর্ব্বতের নিকটবাসী কতকগুলি অনার্য্যজাতি একেবারে মসীকৃষ্ণ। বিষ্ণুপুরাণে তাহাদিগের বর্ণনা আছে। কথিত আছে যে, বেণ রাজার ঊরুদেশ হইতে দগ্ধ কাষ্ঠের ন্যায় খর্ব্বকায় অট্টাস্য এক পুরুষ জন্মে। এই বর্ণনায় মধ্যভারতের খর্ব্বাকৃত অট্টাস্য কৃষ্ণকায় অনার্য্যদিগকে পাওয়া যায়। ঐ পুরুষ নিষাদ নামে সংজ্ঞাত হইয়াছে।* ইহারই বংশে নিষাদাখ্য অনার্য্যজাতির উৎপত্তি।! হরিবংশে বেণের উপাখ্যানে ঐরূপ লিখিত হইয়া, ঐ পুরুষকে নিষাদ ও ধীবর জাতির আদিপুরুষ বলিয়া বর্ণনা আছে।# মনু বলিয়াছেন যে, আয়োগবি অর্থাৎ শূদ্র হইতে বৈশ্যাতে উৎপাদিতা স্ত্রীর গর্ভে নিষাদের ঔরসে মার্গব বা দাস জন্মে। আর্য্যাবর্ত্তে তাহাদিগকে কৈবর্ত্ত বলে।$ অমরকোষাভিধানে কৈবর্ত্তদিগের নাম কৈবর্ত্ত, দাস, ধীবর। পূর্ব্বেই দেখান গিয়াছে যে, ঋগ্বেদ সমালোচনায় দাস নামে অনার্য্যজাতি পাওয়া যায়। দাস, ধীবর, কৈবর্ত্ত তিনই এক। যদি দাস ও ধীবর অনার্য্য হইল, তবে কৈবর্ত্তও অনার্য্যজাতি। এক্ষণে বাঙ্গালায় কৈবর্ত্তের মধ্যে কতকগুলি চাষা কৈবর্ত্ত; কতকগুলি জেলে কৈবর্ত্ত। পূর্ব্বে সকলেই মৎস্যব্যবসায়ী ধীবর ছিল, সন্দেহ নাই। তাহাদিগের সংখ্যা বৃদ্ধি হইলে কতকগুলি কৃষিব্যবসায় অবলম্বন করিল, তাহারাই চাষা কৈবর্ত্ত। ধোপারা ঐরূপ কেহ কেহ চাষ করিয়া চাষাধোপা বলিয়া পৃথক্ জাতি হইয়াছে।

পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্র প্রাচীন জাতির উল্লেখ মন্বাদিতে পাওয়া যায়। মনু লিখিয়াছেন যে, পৌণ্ড্রক প্রভৃতি জাতি ক্রিয়ালোপহেতু বৃষলত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। পৌণ্ড্রকদিগের সঙ্গে আর যে সকল জাতি গণনা করিয়াছেন, তাহাদিগের মধ্যে যবন ও পহ্লব ভারতবর্ষের বাহিরে। ভিতরে সকলগুলিই অনার্য্য; যথা—

“পৌণ্ড্রকাশ্চৌড্রদ্রবিড়াঃ কাম্বোজা যবনাঃ শকাঃ।

পারদাঃ পহ্লবাশ্চীনাঃ কিরাতা দরদাঃ খসাঃ||”

* “কিং করোমীতি তান্ সর্ব্বান্ বিপ্রান্ আহ সে চাতুরঃ।
  নিষীদেতি তমূচুস্তে নিষাদস্তেন সোহভবৎ||”
! “তেন দ্বারেণ নিষ্ক্রান্ত তৎ পাপং তস্য ভূপতেঃ।
  নিষাদাস্তে তথা যাতা বেণকল্মষসম্ভবাঃ||”
# “নিষাদবংশকর্ত্তাসৌ বভূব বদতাং বরঃ।
  ধীবরানসৃজচ্চাপি বেণকল্মষসম্ভবান্||”
$ “নিষাদো মার্গবং সূতে দাসং নৌকর্ম্মজীবিনং।
  কৈবর্ত্তমিতি যং প্রাহুরার্য্যাবর্ত্তনিবাসিনঃ। ||”
  মনুসংহিতা, দশম অধ্যায়, ৩৪ শ্লোক।