বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - বাঙ্গালীর উৎপত্তি
যদি ভারতীয় অনার্য্যদিগের এখনকার বাসস্থান ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিম বা উত্তরপূর্ব্ব প্রদেশ হইত তাহা হইলে অবশ্য বলিতাম যে, তাহারা বাহির হইতে আসিয়া ঐ সকল স্থান খালি পাইয়া বাস করিয়াছে। বস্তুতঃ ভারতবর্ষের প্রান্তভাগে, বিশেষ উত্তরপূর্ব্বভাগে, কতকগুলি অনার্য্যজাতির বাস আছে; এবং তাহারাও যে আর্য্যদিগের আসার পরে আসিয়াছিল, তাহাও ঐতিহাসিক কথা। সে সকল কথা পরে বলিব। অধিকাংশ অনার্য্যজাতি এরূপ সংস্থানবিশিষ্ট নহে। তাহারা কোথাও মধ্যভারতে, কোথাও দক্ষিণে, যেখানে সেখানে বসতি করিতেছে। তাহাদের চারিপাশে আর্য্যনিবাস। ভারতে প্রবেশের পথ আর তাহাদিগের বর্ত্তমান বসতিস্থলের মধ্যে আর্য্যনিবাস। এ অবস্থা দেখিয়া যিনি বলিবেন যে, আর্য্যের পরে এই অনার্য্যেরা আসিয়াছিল, তাঁহাকে বলিতে হইবে যে, অনার্য্যেরা আর্য্যদিগকে জয় করিয়া, আর্য্যনিবাস ভেদ করিয়া, তাহাদের এখনকার বাসে আসিয়াছে। যদি তাহা হইত, তাহা হইলে যে সকল স্থান উত্তম, মনুষ্যবাসের যোগ্য, সেই সকল স্থানে তাহারা বাস করিত। কদর্য্য স্থান সকলে পরাজিতেরা যাইত। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সেরূপ নহে। আনুগঙ্গ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট বাসভূমিতেই আর্য্যনিবাস, কদর্য্য স্থানেই অনার্য্যনিবাস। বিন্ধ্যোত্তর ভারতে যে সকল সুখের স্থান, সেখানে তাহাদের বাস নাই। ইচ্ছা করিয়া যে সকল স্থানে বাস করিতে হয়, সে সকল স্থানে তাহাদের বাস নাই। যেখানে ভূমি উর্ব্বরা, পৃথ্বী সমতলা, নদী নৌবাহিনী, এবং ধনধান্য প্রচুর, সেখানে তাহারা নাই। যেখানে ভূমি অনুর্ব্বরা, পর্ব্বতে পথ বন্ধুর, পৃথিবী অরণ্যময়ী, মনুষ্যভাণ্ডার ধনশূন্য, সেই সকল স্থানে তাহাদের বাস। যাঁহারা বিজয়ী, তাহারা কদর্য্য স্থান সকল বাছিয়া লইবে—যাহারা বিজিত, তাহাদিগকে ভাল স্থান ছাড়িয়া দিবে, ইহা অঘটনীয়। অতএব আর্য্যের পর অনার্য্য আসিয়াছে, এ পক্ষ সমর্থন করা যায় না। কাজেই স্বীকার করিতে হইবে যে, আগে অনার্য্য ছিল, তার পর আর্য্য আসিয়াছে।
দেখা যাউক, এই পূর্ব্ববর্ত্তী অনার্য্য কাহারা। দেশী বিদেশী সকলেই স্বীকার করেন, বেদ প্রাচীন। দেশীয়েরা বলেন, বেদ অপৌরুষেয়। অপৌরুষেয়ত্ববাদ ছাড়িয়া দিয়া, বিদেশীয়দিগের ন্যায় বলা যাউক যে, বেদের ন্যায় প্রাচীন আর্য্যরচনা আর কিছুই নাই। প্রতীচ্যদিগের মত বেদের মধ্যে ঋগ্বেদসংহিতাই প্রাচীন। সেই ঋগ্বেদসংহিতায় “বিজানীহি আর্য্যান্ যে চ দস্যবঃ,” “অয়মতি বিচাকশদ্ বিচিন্বন্ দাস আর্য্যম্”* ইত্যাদি বাক্যে আর্য্য হইতে একটি পৃথক্ জাতি পাওয়া যায়। তাহারা দাস বা দস্যু নামে বেদে বর্ণিত। দস্যু শব্দের এখন প্রচলিত অর্থ-ডাকাত, দাসের প্রচলিত অর্থ চাকর। কিন্তু এ অর্থে দস্যু বা দাস শব্দ ঋগ্বেদ ব্যবহৃত নহে। দাসদিগের স্বতন্ত্র নগর, সুতরাং স্বতন্ত্র্য রাজ্য ছিল।# তাহারা আর্য্যদিগের সহিত যুদ্ধ করিত-তাহাদিগের হস্ত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য আর্য্যেরাও ইন্দ্রাদির পূজা করিতেন। দাস বা দস্যুরা কৃষ্ণবর্ণ—আর্য্যেরা গৌর | তাহারা “বর্হিষ্মান্” যজ্ঞ করে না—আর্য্যেরা যজমান—যজ্ঞ করে | তাহারা “অব্রত”—আর্য্যেরা সব্রত—সুতরাং হে ইন্দ্র, হে অগ্নিম তাহাদের মার, আর্য্যদের বশীভূত কর! আর্য্যদের এই কথা। তাহারা “অদেব”—সুতরাং “বয়ং তান্ বনুয়াম সঙ্গমে”—তাহাদিগকে মারিয়া ফেলিতে চাই। তাহারা “অন্যব্রত”— “অমানুষ”—“অযজমান”—তাহারা “মৃধ্রবাচ”-কথা কহিতেও জানে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
*ঋচ ১। ৫১। ৮-৯। মূরধৃত। মক্সমুলরধৃত Sanskrit Texts, Part II, Chap. III, Sect. I.
#ঋচ। ১০। ৮৬। ১১। মূরধৃত। Ib.
#ঋচ। ১০। ৮৬। ১১। মূরধৃত। Ib.