এই সকল কথার পর্য্যালোচনা করিয়া, হন্টর্ সাহেব সেকালের উড়িয়া-সৈন্যের অনেক প্রশংসা করিয়াছেন। সে প্রশংসা উড়িয়া-সেনার প্রাপ্য নহে, গঙ্গাবংশীয়দিগের স্বদেশী রাঢ়ীসৈন্যের প্রাপ্য। সকলেই জানেন যে, উড়িষ্যার গঙ্গাবংশীয়দিগের সাম্রাজ্য গোদাবরী হইতে সরস্বতী পর্য্যন্ত অর্থাৎ বাঙ্গালায় ত্রিবেণী পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এক্ষণে যাহা মেদিনীপুর জেলা এবং হাবরা জেলা, তাহার সমুদয় এবং যাহা বর্দ্ধমান ও হুগলি জেলার অন্তর্গত, তাহার কিয়দংশ ঐ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ইহাই গঙ্গাবংশীয়দিগের পৈতৃক রাজ্য। যেমন নর্ম্মান্ উইলিয়ম্ ইংলণ্ড জয় করিয়া নর্ম্মাণ্ডির রাজধানী পরিত্যাগপূর্ব্বক ইংলণ্ডের রাজধানীতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন, তেমনি গঙ্গাবংশীয়েরা উড়িষ্যা জয় করিয়া, আপনাদিগের প্রাচীন রাজধানী পরিত্যাগপূর্ব্বক উড়িষ্যায় বাস করিতে লাগিলেন বটে, কিন্তু তাঁহারা পৈতৃক রাজ্য ছাড়েন নাই। উহাও তাঁহাদিগের রাজ্যভুক্ত রহিল, ইহাই সম্ভব। সেই জন্যই ত্রিবেণী পর্য্যন্ত উড়িষ্যার অধিকার ছিল। বাঙ্গালার মুসলমানেরা গঙ্গাবংশীয়দিগকে আক্রমণ করিলে, কাজেই প্রথমে এই রাঢ়দেশ আক্রমণ করিত, এবং এই রাঢ়ীগণ কর্ত্তৃকই পুনঃ পুনঃ পরাভূত হইত।

এক্ষণে অনেকে জিঞ্জাসা করিতে পারেন যে, রাঢ়ী বাঙ্গালীরা যদি এত বলবিক্রমযুক্ত ছিল, তবে অন্যান্য বাঙ্গালীরা এত হীনবীর্য্য কেন? আমাদিগের উত্তর যে, অন্য বাঙ্গালীরা রাঢ়ীদিগের অপেক্ষা হীনবীর্য্য ছিল, এমন বিবেচনা করিবার কোন কারণ নাই। বরং এই রাঢ়ীরাও অন্য বাঙ্গালীদিগের দ্বারা পরাভূত হইয়াছিল, ইহাও বিবেচনা করিবার কারণ আছে। রাঢ়দেশের কিয়দংশ সেনরাজাদিগের রাজ্যভুক্ত ছিল,* এবং সেনরাজারা গঙ্গাবংশীয়দিগের নিকট কাড়িয়া লইয়াছিলেন, এমন বিবেচনাকরা অসঙ্গত হয় না। অন্য বাঙ্গালীদিগকে অপেক্ষাকৃত হীনবীর্য্য মনে করিবার একমাত্র কারণ এই যে, মুসলমানেরা অতি সহজে বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল। বস্তুতঃ মুসলমানেরা সহজে বাঙ্গালা জয় করে নাই—কেবল লক্ষ্মণাবতীই সহজে জয় করিয়াছিল। তাহারা তিন শত বৎসরেও সমস্ত বাঙ্গালা জয় করিতে পারে নাই। মুসলমানেরা স্পেন্ হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্য্যন্ত কালে সমস্ত অধিকার করিয়াছিল বটে, কিন্তু ভারতবর্ষ জয় করা তাহাদিগের পক্ষে যেরূপ দুরূহ হইয়াছিল, এমন আর কোন দেশই হয় নাই, ইহা “ভারতকলঙ্ক” শীর্ষক প্রবন্ধে প্রমাণীকৃত হইয়াছে। ভারতবর্ষের মধ্যে আবার পাঁচটি জনপদে তাহারা বড় ঠেকিয়াছিল, এমন আর কোথাও না। ঐ পাঁচটি প্রদেশ—(১) পঞ্জাব, (২) সিন্ধুসৌবীর, (৩) রাজস্থান, (৪) দাক্ষিণাত্য, (৫) বাঙ্গালা। বাঙ্গালা জয় যে সহজে হয় নাই, ইহার প্রমাণ দিতে আমরা প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমরা যতটুকু লিখিয়াছি, তাহাই এ ক্ষুদ্র পত্রের পক্ষে দীর্ঘ প্রবন্ধ হইয়াছে।

*এই জন্যই কায়স্থ প্রভৃতি জাতির মধ্যে উত্তররাঢ়ী ও দক্ষিণরাঢ়ী বলিয়া প্রভেদ আছে। রাজ্য পৃথক্ হওয়াতে সমাজও পৃথক্ হইয়াছিল।