বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - বাঙ্গালার কলঙ্ক
অনেকে বলিবেন যে, কৈ প্রবলপ্রতাপান্বিত গঙ্গারাঢ়ীদিগের নাম তখন আমরা কেহ পূর্ব্বে শুনি নাই। যখন মার্সমান্ প্রভৃতি ইংরেজ ইতিহাসবেত্তাদিগের কাছে আমরা স্বদেশের ইতিহাস শিখি, তখন গঙ্গারাঢ়ীর নাম আমাদের শুনিবার সম্ভাবনা কি? কিন্তু গঙ্গারাঢ়ী নাম আমরা নূতন গড়িলাম না, তাহার ঐতিহাসিক প্রমাণ দিতেছি। যেখানে দেখিতেছি যে, যে প্রদেশবাসীদিগকে মেগাস্থিনিস্ Gangaridae বলেন, সেই প্রদেশবাসীদিগকেই লোকে এখন রাঢ়ী বলে, আমাদের বিবেচনায় গঙ্গারাঢ়ী নামের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে ইহাই যথেষ্ট প্রমাণ। কিন্তু আমরা কেবল সে প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া এ নাম ব্যবহার করিতেছি না। অনেকে অবগত আছেন, মাকেঞ্জির সংগ্রহ (Mackenzie’s Collection) নামে কতকগুলি দুর্লভ ভারতবর্ষীয় পুস্তকের সংগ্রহ আছে। সেগুলি মুদ্রাঙ্কিত হইয়া প্রচার হইবার সম্ভাবনা নাই এবং সকলের প্রাপ্যও নহে। অথচ তাহাতে মধ্যে মধ্যে বিচিত্র নূতন ঐতিহাসিক তত্ত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেই সকল গ্রন্থের একটি তালিকা উইল্সন্ সাহেব প্রচারিত করিয়াছেন, এবং তৎসঙ্গে উহা হইতে কতকগুলি ঐতিহাসিক তত্ত্ব সংগ্রহ করিয়া প্রকাশিত করিয়াছেন। ঐ গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় দেখিবেন, লিখিত আছে যে, গঙ্গারাঢ়ীর অধীশ্বর অনন্তবর্ম্মা বা কোলাহল কলিঙ্গ জয় করিয়াছিলেন। এ কথা প্রস্তর-শাসনে লিখিত আছে, আমরা গঙ্গারাঢ়ী নাম নূতন গড়ি নাই। তবে অনভিজ্ঞ ইংরাজেরা বাঙ্গালার ইতিহাস লিখিতে প্রবৃত্ত হওয়ায় আর সেই সকল গ্রন্থ প্রচলিত হওয়ায়, বাঙ্গালার পূর্ব্বগৌরব প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে।
এই যে অনন্তবর্ম্মা বা কোলাহল রাজার উল্লেখ করিলাম, ইনিও বাঙ্গালীর পূর্ব্বগৌরবের এক চিরস্মরণীয় প্রমাণ। উড়িষ্যার বিখ্যাত গঙ্গাবংশ নামে যে রাজবংশ, ইনিই তাহার আদিপুরুষ। কেহ কেহ বলেন যে, গঙ্গাবংশীয়েরা দক্ষিণদেশ হইতে উড়িষ্যায় আসিয়াছিল এবং চোরঙ্গা বা চোরগঙ্গা নামে একজন দাক্ষিণাত্য রাজা এই বংশ সংস্থাপন করেন। এ কথাটি মিথ্যা। এই প্রবল প্রতাপশালী মহামহিমময় রাজবংশীয়েরা যে বাঙ্গালী ছিলেন,* এই কথা যাঁহারা বিশ্বাস করিতে অনিচ্ছুক, তাঁহারাই সে পক্ষ সমর্থন করেন। উইল্সন্ সাহেবের কথিত গ্রন্থে কথিত পৃষ্ঠাতেই যে একখানি শাসনের উল্লেখ আছে, তাহাতে লিখিত আছে, রাঢ়ী কোলাহলই উড়িষ্যাবিজেতা এবং গঙ্গাবংশের আদিপুরুষ। তাম্রফলক বা প্রস্তর এ বিষয়ে মিথ্যা কথা বলিবে না।
ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে যে সকল রাজবংশের আবির্ভাব হইয়াছিল, এই বাঙ্গালী গঙ্গাবংশীয়দিগের প্রতাপ ও মহিমা কাহারও অপেক্ষা ন্যূন ছিল না। পুরীর মন্দির ও কোণার্কের আশ্চর্য্য প্রাসাদাবলী তাহাদিগেরই গঠিত। বাঙ্গালার পাঠানেরা যত বার তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত হইয়াছিল, তত বার পরাভূত, তাড়িত এবং অপমানিত হইয়াছিল। বরং গঙ্গাবংশীয়েরা তাহাদিগকে প্রহার করিতে করিতে পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া তাড়াইয়া লইয়া যাইত। একদা পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া, পাঠানদিগের রাজধানী গৌড় এবং নগর আক্রমণ করিয়া লুঠপাঠ করিয়া পাঠানের সর্ব্বস্ব লইয়া ঘরে ফিরিয়া যান। উদ্ধত মুসলমানদিগকে গঙ্গাবংশীয়েরা তিন শত বৎসর ধরিয়া যেরূপ শাসিত রাখিয়াছিলেন, সেরূপ চিতোরের রাজবংশ ভিন্ন আর কোন হিন্দুরাজবংশ পারেন নাই। তাঁহারা যেমন বাঙ্গালায় মুসলমানদিগকে শাসনে রাখিয়াছিলেন, দাক্ষিণাত্যের হিন্দুরাজদিগকেও তেমনি শাসিত রাখিয়াছিলেন।
*“বর্ম্মা” শব্দে বুঝাইতেছে যে, উঁহারা ক্ষত্রিয় ছিলেন। ক্ষত্রিয় হইলে বাঙ্গালী হইল না, ভরসা করি, এ আপত্তি কেহ করিবেন না। বাঙ্গালার ক্ষত্রিয়কে বাঙ্গালী বলিব না, তবে বাঙ্গালার ব্রাহ্মণকেই বা বাঙ্গালী বলিব কেন?