বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার
কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, আদিশূরের সময়ে যে কেবল সাড়ে সাত শত ঘর মাত্র ব্রাহ্মণ দেখিতেছ, তাহার কারণ এমত নহে যে, ব্রাহ্মণেরা স্বল্পদিন মাত্র বাঙ্গালায় আসিয়াছিলেন। বৌদ্ধধর্ম্মের প্রাবল্যই ব্রাহ্মণসংখ্যার অল্পতার কারণ। কিন্তু বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম্মের যেরূপ প্রাবল্য ছিল, মগধ কান্যকুব্জাদি দেশেও তদ্রূপ বা তদধিক ছিল। বৌদ্ধধর্ম্মের প্রাবল্য হেতু যদি বাঙ্গালায় ব্রাহ্মণসংখ্যা স্বল্পীভূত হইয়াছিল, তবে সমগ্র ভারতবর্ষেও সেই কারণে ব্রাহ্মণবংশ লুপ্তপ্রায় হইয়াছিল, স্বীকার করিতে হইবে। কোন কোন আপত্তিকারী তাহাও স্বীকার করিতে পারেন। বলিতে পারেন যে, তখন সমস্ত ভারতেই অল্প ব্রাহ্মণ ছিল-এক্ষণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কিন্তু তাহা হইলে জিজ্ঞাসা করি, যদি পূর্ব্ব হইতে বঙ্গে ব্রাহ্মণের বাস ছিল, তবে আদিশূরের পূর্ব্বকালজাত কোন গ্রন্থে তাহার নিদর্শন পাওয়া যায় না কেন? বরং প্রাচীন গ্রন্থাদিতে তথায় ব্রাহ্মণের বাস না থাকারই নিদর্শন পাওয়া যায় কেন?* আমরা পাঠকদিগকে জিজ্ঞাসা করি যে, অষ্টম শতাব্দীর বা আদিশূরের পূর্ব্ববর্ত্তী কোন বঙ্গবাসী গ্রন্থকারের নাম তাঁহারা স্মরণ করিয়া বলিতে পারেন? কুল্লুকভট্ট, জয়দেব, গোবর্দ্ধনাচার্য্য, হলায়ুধ, উদয়ানাচার্য্য প্রভৃতি যাহার নাম করিবেন, সকলই আদিশূরের পরবর্ত্তী। ভট্টনারায়ণ ও শ্রীহর্ষ তাঁহার সমকালিক। প্রাচীন আর্য্যজাতি যেখানে বাস করিয়াছেন, সেইখানেই ব্রাহ্মণগণ তাঁহাদিগের পাণ্ডিত্যের চিহ্নস্বরূপ গ্রন্থাদি রাখিয়া গিয়াছেন। বাঙ্গালায় যখন ব্রাহ্মণ ছিলেন না, তখনকার প্রণীত পুস্তকাদিও নাই।
আমরা অবশ্য ইহা স্বীকার করি যে, অষ্টম শতাব্দীর পূর্ব্বেও আর্য্য রাজকুল বাঙ্গালায় ছিল, এবং তাহাদিগের আনুষঙ্গিক ব্রাহ্মণও থাকিতে পারেন। সেরূপ অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ আমাদিগের আলোচনার বিষয় নহে। সেরূপ সকল জাতিই সকল দেশে থাকে। কালিফর্ণিয়াতেও অনেক চীন আছে।
আমরা যে কথা সপ্রমাণ করিবার জন্য যত্ন পাইয়াছি, তাহা যদি সত্য হয়, তবে অনেকেই মনে করিবেন যে, বাঙ্গালার ও বাঙ্গালীর বড় লাঘব হইল। আমরা আধুনিক বলিয়া বাঙ্গালীজাতির অগৌরব করা হইল; আমরা প্রাচীন জাতি বলিয়া আধুনিক ইংরেজদিগের সম্মুখে স্পর্দ্ধা করি-তা না হইয়া আমরাও আধুনিক হইলাম।
আমরা দেখিতেছি না যে, অগৌরব কিছু হইল। আমরা সেই প্রাচীন আর্য্যজাতিসম্ভূতই রহিলাম—বাঙ্গালায় যখন আসি না কেন, আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ সেই গৌরবান্বিত আর্য্য। বরং গৌরবের বৃদ্ধিই হইল। আর্য্যগণ বাঙ্গালায় তাদৃশ কিছু মহৎ কীর্ত্তি রাখিয়া যান নাই—আর্য্যকীর্ত্তিভূমি উত্তর পশ্চিমাঞ্চল। এখন দেখা যাইতেছে যে, আমরা সে কীর্ত্তি ও যশেরও উত্তরাধিকারী। সেই কীর্ত্তিমন্ত পুরুষগণই আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষ। দোবে, চোবে, পাঁড়ে, তেওয়ারীর মত আমরাও ভারতীয় আর্য্যগণের প্রাচীন যশের ভাগী বটে।
আমাদের আর একটি কলঙ্কের লাঘব হইতেছে। আদিশূরের সময়ে মোটে সাড়ে সাত শত ঘর ব্রাহ্মণ ছিল। বল্লালের সময় সেই সাত শত ঘরের বংশ এবং পঞ্চ ব্রাহ্মণের বংশ একাদশ শত ঘর ছিল। ক্ষত্রিয় বৈশ্য এখনও যখন অতি অল্পসংখ্যক, তবে তখন যে আরও অল্পসংখ্যক ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। বল্লালের দেড় শত বৎসর পরে মুসলমানগণ বঙ্গজয় করেন। তখন বঙ্গীয় আর্য্যগণের সংখ্যা অধিক সহস্র নহে, ইহা অনুমেয়। তখনও তাঁহারা এদেশে ঔপনিবেশিক মাত্র। সুতরাং সপ্তদশ অশ্বারোহী কর্ত্তৃক বঙ্গজয়ের যে কলঙ্ক, তাহা আর্য্যদিগের কিছু কমিতেছে বটে।
তখন বঙ্গীয় আর্য্যগণের অভ্যুদয়ের সময় হয় নাই। এখন সে সময় বোধ হয় উপস্থিত। বাহুবল না হউক, বুদ্ধিবলে যে বাঙ্গালী অচিরে পৃথিবীমধ্যে যশস্বী হইবে, তাহার সময় আসিতেছে।
আমরা উপরে ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, কায়স্থগণ সম্বন্ধে তাহা বর্ত্তে। বিদ্যানিধি মহাশয় বলেন, কায়স্থগণ সৎশূদ্র অর্থাৎ বর্ণসঙ্কর নহে। আমাদিগের বিবেচনায় তাহারা বর্ণসঙ্কর বটে। তদ্বিষয়ে বঙ্গদর্শনে ইতিপূর্ব্বে অনেক বলা হইয়াছে। এক্ষণে আর কিছুই বলিবার প্রয়োজন নাই। সঙ্করতা হেতু কায়স্থগণ আর্য্যবংশসম্ভূত বটে। আদিশূরের সময় পঞ্চ ব্রাহ্মণের সঙ্গে পাঁচ জন কায়স্থও কান্যকুব্জ হইতে আসিয়াছিলেন। তৎপূর্ব্ব যেমন বাঙ্গালায় ব্রাহ্মণ ছিল, সেইরূপ কায়স্থও ছিল, কিন্তু অল্পসংখ্যক। এক্ষণে কায়স্থগণ বঙ্গদেশের অলঙ্কারস্বরূপ।
*বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার প্রথম প্রস্তাব দেখ।