সুবিখ্যাত ফুলের মুখটি নীলকণ্ঠ ঠাকুরের বংশ বাঙ্গালায় কত বিস্তৃত, তাহা রাঢ়ীয় কুলীনগণ জানেন। এক একখানি ক্ষুদ্র গ্রামেও পাঁচ সাত ঘর পাওয়া যায়; কোন কোন বড় গ্রামে তাঁহাদিগের সংখ্যা অগণ্য। যে বলিবে যে, সমগ্র বাঙ্গালায় একাদশ শত ঘর মাত্র নীলকণ্ঠ ঠাকুরের সন্তান বাস করে, সে অন্যায় বলিবে না। কিন্তু কয় পুরুষ মধ্যেই এই বংশবৃদ্ধি হইয়াছে? বহুসংখ্যক নীলকণ্ঠ ঠাকুরের সন্তানের সঙ্গে বর্ত্তমান লেখকের পরিচয়, বন্ধুত্ব এবং কুটুম্বিতা আছে। তাঁহারা নীলকণ্ঠ হইতে কেহ সপ্তম, কেহ অষ্টম, কেহ নবম পুরুষ। যদি সাত আট পুরুষে এরূপ সংখ্যাবৃদ্ধি, একজন হইতে পারে, তবে দেড় শত বৎসরে ৫ জন হইতে একাদশ শত ঘর হওয়া নিতান্ত অশ্রদ্ধেয় কথা নহে।

এক্ষণে বোধ হয় চারিটি বিষয় বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া স্থির হইতেছে।

১ম। আদিশূর পঞ্চ ব্রাহ্মণকে আনিবার পূর্ব্বে এতদ্দেশে সাড়ে সাত শত ঘর ব্যতীত ব্রাহ্মণ ছিল না।

২য়। ৯৪২ খ্রীঃ অব্দে আদিশূর ঐ পঞ্চ ব্রাহ্মণকে আনয়ন করেন।

৩য়। তাহার দেড় শত বৎসর পরে বল্লালসেন ঐ পঞ্চ ব্রাহ্মণের বংশসম্ভূত ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কৌলীন্য প্রচলিত করেন।

৪র্থ। এ দেড় শত বৎসরে ঐ পাঁচ ঘর ব্রাহ্মণে এগার শত ঘর হইয়াছিল।

যদি দেড় শত বৎসরে পাঁচ জন ব্রাহ্মণের বংশে একাদশ শত ঘর হইয়াছিল, তবে কত কালে বঙ্গদেশের আদিম ব্রাহ্মণগণের বংশ সাড়ে সাত শত ঘর হইয়াছিল।

যদি সপ্তশতীদিগের আদিপুরুষও পাঁচ জন ছিলেন এবং যদি তাঁহারাও কান্যকুব্জীয়দিগের ন্যায় বহুবিবাহপরায়ণ ছিলেন, ইহা বিবেচনা করা যায়, তবে বাঙ্গালায় প্রথম ব্রাহ্মণদিগের আগমনকাল হইতে শত বৎসর মধ্যে তাঁহাদের বংশে এই সাড়ে সাত শত ঘর ব্রাহ্মণের জন্ম অসম্ভব নহে।

সপ্তশতীদিগের পূর্ব্বপুরুষগণও বহুবিবাহপরায়ণ ছিলেন, ইহা অনুমানে দোষ হয় না। কেন না, বহুবিবাহ তৎকালে বিলক্ষণ প্রচলিত দেখা যাইতেছে। তবে এমন হইতে পারে যে, কান্যকুব্জীয়গণ বিশেষ সুব্রাহ্মণ বলিয়া সপ্তশতীগণও তাঁহাদিগকে কন্যাদানে উৎসুক হইতেন, এই জন্য তাঁহারা অনেক বিবাহ করিয়াছিলেন; সপ্তশতীগণের পূর্ব্বপুরুষের মত বিবাহ করিবার কোন কারণ ছিল না। তেমন এদিকে পাঁচ জন মাত্র যে তাঁহাদিগের আদিপুরুষ, ইহা অসম্ভব। বরং ব্রাহ্মণ আসিতে একবার আরম্ভ হইলে, ক্রমে ক্রমে, একত্রে বা একে একে রাজগণের প্রয়োজনানুসারে বা রাজপ্রসাদ লাভাকাঙ্ক্ষায় অধিকসংখ্যক আসাই সম্ভব।

অতএব কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আসিবার পূর্ব্বে এক শত বৎসরের মধ্যেই বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণদিগের প্রথম বাস, বিচারসঙ্গত বোধ হইতেছে। অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর পূর্ব্বে বাঙ্গালা ব্রাহ্মণশূন্য অনার্য্যভূমি ছিল। পূর্ব্বে কদাচিৎ কোন ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে যদি আসিয়া বাস করিয়া থাকেন, তাহা গণনীয়ের মধ্যে নহে। অষ্টম শতাব্দীর পূর্ব্বে বাঙ্গালায় ব্রাহ্মণসমাজ ছিল না।