বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - চিত্তশুদ্ধি
ইহার অর্থ
“মা! নির্গুণ ভক্তিযোগ কিরূপ, তাহাও বলি, শ্রবণ করুন। আমার গুণ শ্রবণমাত্রে সর্ব্বান্তর্যামী যে আমি, আমাতে অর্থাৎ পুরুষোত্তমে সমুদ্রগামী গঙ্গাসলিলের ন্যায় অবিচ্ছিন্না ও ফলানুসন্ধানরহিতা এবং ভেদদর্শনবর্জ্জিতা মনের গতিরূপ যে ভক্তি, তাহাই নির্গুণ ভক্তিযোগের লক্ষণ। ১০। যে সকল ব্যক্তির এইরূপ ভক্তিযোগ হয়, তাহাদের কোনই কামনা থাকে না, অধিক কি, তাহাদিগকে সালোক্য (আমার সহিত এক লোকে বাস), সার্ষ্টি (আমার তুল্য ঐশ্বর্য্য), সামীপ্য (সমীপবর্ত্তিত্ব), সারূপ্য (সমানরূপত্ব) এবং একত্ব অর্থাৎ সাযুজ্য, এই সকল মুক্তি দিতে চাহিলেও তাঁহারা আমার সেবা ব্যতিরেকে কিছুই গ্রহণ করিতে চাহেন না। ১১। মা! ঐ প্রকার ভক্তিযোগকেই আত্যন্তিক বলা যায়, উহা হইতে পরমপুরুষার্থ আর নাই। মানবি! ত্রৈগুণ্য ত্যাগ করিয়া ব্রহ্মপ্রাপ্তি পরম ধন বলিয়া প্রসিদ্ধ আছে সত্য, কিন্তু তাহা আমার ঐ আনুষঙ্গিক ধন, ভক্তিযোগেই ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মত্বপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। ১২। মা! ঐ প্রকার ভক্তির সাধন বলি, শ্রবণ করুন। ধনাভিসন্ধি পরিত্যাগপূর্ব্বক নিত্তনৈমিত্তিক স্ব স্ব ধর্ম্মের অনুষ্ঠান এবং নিত্য শ্রদ্ধাদিযুক্ত হইয়া নিষ্কামে অনতিহিংস্র অর্থাৎ একবারে হিংসাদি বর্জ্জন না করিয়া পঞ্চরাত্রাদ্যুক্ত পূজাপ্রকরণ দ্বারা। ১৩। আমার প্রতিমাদি দর্শন, স্পর্শন, পূজন, স্তবকরণ, বন্দন, সকল প্রাণীতে আমার ভাব চিন্তাকরণ, ধৈর্য্য, বৈরাগ্য, মহৎ ব্যক্তিদিগকে বহু সম্মানকরণ, দীনের প্রতি অনুকম্পা, আত্মতুল্য ব্যক্তিতে মৈত্রতা, যম অর্থাৎ বাহ্যেন্দ্রিয়ের নিগ্রহ, নিয়ম অর্থাৎ অন্তরিন্দ্রিয় দমন, আত্মবিষয়ক শ্রবণ, আমার নাম সংকীর্ত্তন, সরলতাচরণ, সতের সঙ্গকরণ এবং নিরহঙ্কারিতা প্রদর্শন। ১৪। ঐ সকল গুণ দ্বারা ভগবদ্ধর্ম্মানুষ্ঠানকারী পুরুষের চিত্ত সর্ব্বতোভাবে শুদ্ধ হয়, এবং সেই পুরুষ আমার গুণ শ্রবণমাত্রে বিনা প্রযত্নে আমাকে প্রাপ্ত হয়। ১৫। ফলতঃ যেমন গন্ধ বায়ুযোগে স্বস্থান হইতে আসিয়া ঘ্রাণকে আশ্রয় করে, তাহার ন্যায় ভক্তিযোগযুক্ত অধিকারী চিত্ত বিনা প্রযত্নেই পরমাত্মাকে আত্মসাৎ করে। ১৬। এই প্রকার চিত্তশুদ্ধি সর্ব্বপ্রাণীতে আত্মদৃষ্টি দ্বারাই হয়, আমি সকল ভূতের আত্মস্বরূপ হইয়া সর্ব্বপ্রাণীতেই সতত অবস্থিত আছি, অথচ কোন কোন ব্যক্তি আমাকে অবজ্ঞা করিয়া প্রতিমাদিতে প্রজারূপ বিড়ম্বনা করিয়া থাকে। ১৭। পরন্তু আমি সর্ব্বপ্রাণীতে বর্ত্তমান ও সকলের আত্মা এবং ঈশ্বর; যে ব্যক্তি মূঢ়তাপ্রযুক্ত আমাকে উপেক্ষা করিয়া প্রতিমা পূজা করে, তাহার কেবল ভস্মে আহুতি প্রদান করা হয়। সে পরদেহে আমাকে দ্বেষ করে এবং অভিমানী ভিন্নদর্শী ও সকল প্রাণীর সহিত বদ্ধবৈর হয়, সুতরাং তাহার মন শান্তি প্রাপ্ত হয় না। ১৮। হে অনঘে! যে ব্যক্তি প্রাণিসমূহের নিন্দাকারী, সে যদি বিবিধ দ্রব্য ও বিবিধ দ্রব্যে উৎপন্নাদি ক্রিয়া দ্বারা আমার প্রতিমাতে আমার পূজা করে, তথাচ আমি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হই না। ১৯। মা! এমত বিবেচনা করিবেন না যে, প্রতিমাদিতে অর্চ্চনা করা বিফল। পুরুষ যে পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রাণীতে অবস্থিত যে আমি, আমাকে আপনার হৃদয়মধ্যে জানিতে না পারে, তাবৎ পর্য্যন্ত স্বকর্ম্মে রত হইয়া প্রতিমাদিতে অর্চ্চনা করিবে। ২০। পরন্তু যে মূঢ় আপনার ও পরের মধ্যে অত্যল্পও ভেদ দর্শন করে অর্থাৎ যাহার আপনার দুঃখের তুল্য পরের দুঃখ অনুভব হয় না, আমি সেই ভিন্নদর্শী ব্যক্তির প্রতি মৃত্যুস্বরূপ হইয়া ঘোরতর ভয় বিধান করি। ২১। অতএব পুরুষের কর্ত্তব্য যে, আমাকে সর্ব্বভূতের অন্তর্যামী এবং সকল প্রাণীতে অবস্থিত জানিয়া দান, মান ও সকলের সহিত মিত্রতা এবং সমদৃষ্টি দ্বারা সকলকে অর্চ্চনা করে। ২২|” *
চিত্তশুদ্ধি সম্বন্ধে এইরূপ উক্তি হিন্দুধর্ম্মের সকল গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করা যাইতে পারে, বাহুল্যে প্রয়োজন নাই। হিন্দুদিগের স্মরণ থাকে যেন যে, চিত্তশুদ্ধি ব্যতীত প্রতিমাদি পূজায় কোন ধর্ম্ম নাই। সে স্থলে প্রতিমাদির পূজা বিড়ম্বনা মাত্র।
এই চিত্তশুদ্ধি মনুষ্যদিগের সকল বৃত্তিগুলির সম্যক্ স্ফূর্ত্তি, পরিণতি, ও সামঞ্জস্যের ফল। ভক্তি ও প্রীতি কার্য্যকারিণী বৃত্তি। কিন্তু কেবল কার্য্যকারিণী বৃত্তির অনুশীলনে ধর্ম্মলাভ হইতে পারে না। জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির অনুশীলন ব্যতীত ধর্ম্মের স্বরূপজ্ঞান হইতে পারে না। চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিগুলির অনুশীলন ব্যতীত ধর্ম্মের মাহাত্ম্য এবং সৌন্দর্য্য সম্যক্রূপ উপলব্ধ হয় না, এবং চিত্তশুদ্ধির সকল পথ পরিষ্কার হয় না। শারীরিক বৃত্তিসকলের সমুচিত অনুশীলন ব্যতীত ধর্ম্মানুমোদিত কার্য্যের উপযোগী ক্ষমতা জন্মে না এবং হৃদয়ও শান্তিলাভ করে না। অতএব চিত্তশুদ্ধি, সকল বৃত্তিগুলির সম্যক্ অনুশীলন ও সামঞ্জস্যেরই ফল।
* শ্রীযুক্ত রামনারায়ণ বিদ্যারত্নকৃত অনুবাদ। অনুবাদে মূলাতিরিক্ত দুই একটা শব্দ আছে।