লোকরহস্য
বাড়ীর গৃহিণী মনে ভাবিলেন, “সে উপরি লোক, তাহাকে বাড়ীর ভিতর আনিয়া জল খাওয়ান হইতে পারে না। জামাইকেও বাহিরে খাওয়ান হইতে পারে না। তা, তার জায়গা হউক বাহিরে, আর জামাইয়ের জায়গা হউক ভিতরে |” গৃহিণী সেইরূপ বন্দোবস্ত করিলেন। রামা বাহিরে, জলযোগের উদ্যোগ দেখিয়া বড় ক্রুদ্ধ হইল, ভাবিল, “এ কি অলৌকিকতা?” এদিকে দাসী কালীকান্তকে অন্তঃপুরে ডাকিয়া আনিল। ঘরের ভিতর স্থান হইয়াছে, কিন্তু কালীকান্ত উঠানে দাঁড়াইয়া বলিল, “আমাকে ঘরের ভিতর কেন? আমাকে এইখানে হাতে দুটো ছোলা গুড় দাও, খেয়ে একটু জল খাই |” শুনিয়া শালীরা বলিল, “বোসজা মশাই যে এবার অনেক রকম রসিকতা শিখে এয়েছ দেখতে পাই |” কালীকান্ত কাতর হইয়া বলিল, “আজ্ঞে, আমাকে ঠাট্টা করেন কেন, আমি আপনাদের তামাসার যোগ্য?” একজন প্রাচীনা ঠাকুরাণীদিদি বলিল, “আমাদের তামাসার যোগ্য কেন?-যার তামাসার যোগ্য, তার কাছে চল |” এই বলিয়া কালীকান্তের হাত ধরিয়া হড়হড় করিয়া টানিয়া ঘরের ভিতর লইয়া আসিল।
সেখানে কালীকান্তের ভার্য্যা কামসুন্দরী দাঁড়াইয়া ছিল। কালীকান্ত তাহাকে দেখিয়া প্রভুপত্নী মনে করিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল।
কামসুন্দরী দেখিয়া চন্দ্রবদনে মধুর হাসি হাসিয়া বলিল, “ওকি ও রঙ্গ-এ আবার কোন্ ঠাট শিখিয়া আসিয়াছ?” শুনিয়া কালীকান্ত কাতর হইয়া কহিল, “আজ্ঞে, আমার সঙ্গে অমন সব কথা কেন-আমি আপনার চাকর-আপনি মুনিব!”
রসিকা কামসুন্দরী বলিল, “তুমি চাকর, আমি মুনিব, সে আজ না কাল? যত দিন আমার বয়স আছে, তত দিন এই সম্পর্কই থাকিবে। এখন জল খাও |”
কালীকান্ত মনে করিল, “বাবা, এঁর কথার ভাব যে কেমন কেমন। আমাদের বাবু যে একটা গেছো মেয়ের হাতে পড়েছেন দেখতে পাই। তা, আমার সবাই ভাল |” এই ভাবিয়া কালীকান্ত পুনর্ব্বার ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া পলাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, দেখিয়া কামসুন্দরী আসিয়া তাঁহার গাত্রবস্ত্র ধরিল; বলিল, “ওরে আমার সোণারচাঁদ! আমার সাত রাজার ধন এক মাণিক! আমার কাছ থেকে আর পলাতে হয় না |” এই বলিয়া কামসুন্দরী স্বামীকে আসনের দিকে টানিতে লাগিল।
কালীকান্ত আন্তরিক কাতরতার সহিত হাত যোড় করিয়া বলিতে লাগিল, “দোহাই বৌঠাকুরাণি, আপনার সাত দোহাই-আমাকে ছাড়িয়া দিন-আপনি আমার স্বভাব জানেন না-আমি সে চরিত্রের লোক নই |” কামসুন্দরী হাসিয়া বলিল, “তুমি যে চরিত্রের লোক, আমি বেশ জানি-এখন জল খাও |”
কালীকান্ত বলিল, “যদি আপনার কাছে কেহ আমার এমন নিন্দা করিয়া থাকে, তবে সে ঠক-ঠকাম করিয়াছে। আপনার কাছে হাতযোড় করিতেছি, আপনি আমার গুরুজন, আমায় ছাড়িয়া দিন |”
কামসুন্দরী রসিকতাপ্রিয়; মনে করিল যে, এ একতর নূতন রসিকতা বটে। বলিল, “প্রাণাধিক, তুমি কত রসিকতা শিখিয়া আসিয়াছ, তাহা বুঝা যাইবে |” এই বলিয়া স্বামীর দুই হস্ত ধারণ করিয়া আসনে বসাইবার জন্য টানিতে লাগিল।
হস্তধারণ মাত্র কালীকান্ত সর্ব্বনাশ হইল মনে করিয়া “বাবা রে, গেলাম রে, এগো রে, আমায় মেরে ফেল্লে রে” বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। চীৎকার শুনিয়া গৃহস্থ সকলে ভীত হইয়া দৌড়িয়া আসিল। মা, ভগিনী, পিসী প্রভৃতিকে দেখিয়া কামসুন্দরী স্বামীর হস্ত ছাড়িয়া দিল। কালীকান্ত অবসর পাইয়া ঊর্দ্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।
গৃহিণী কামসুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি লা কামি-জামাই অমন করে উঠ্লো কেন? তুই কি মেরেছিস্?”
বিস্মিতা কামসুন্দরী মর্ম্মপীড়িতা হইয়া কহিল, “মারিব কেন? আমি মারিব কেন-আমার যেমন পোড়া কপাল!” ক্রমে ক্রমে সুর কাঁদনিতে চড়িতে লাগিল-“আমার যেমন পোড়া কপাল-কোন্ আবাগী আমার সর্ব্বনাশ করেছে-কে ওষুধ করেছে___” বলিতে বলিতে কামসুন্দরী কাঁদিয়া হাট লাগাইল।
সকলেই বলিল, “হাঁ তুই মেরেছিস্; নহিলে অমন কাতরাবে কেন?” এই বলিয়া সকলে কামকে “পাপিষ্ঠা” “ডাইনী” “রাক্ষসী” ইত্যাদি কথায় ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। কামসুন্দরী বিনাপরাধে নিন্দিতা ও ভর্ৎসিতা হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে গিয়া দ্বার দিয়া শুইয়া পড়িল।