কৈলাসে গৌরী বলিলেন, “প্রভো, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আপনার স্বর্ণগোলকের কি গুণ এ?”

মহাদেব বলিলেন, “গোলকের গুণ চিত্তবিনিময়। আমি যদি নন্দীর হাতে এই গোলক দিই, তবে নন্দী ভাবিবে, আমি মহাদেব, আমাকে ভাবিবে নন্দী; আমি ভাবিব, আমি নন্দী, নন্দীকে ভাবিব মহাদেব। রামা ভাবিতেছে, আমি কালীকান্ত বসু, কালীকান্তকে ভাবিতেছে, এ রামা চাকর। কালীকান্ত ভাবিতেছে, আমি রামা খানসামা, রামাকে ভাবিতেছে, কালীকান্তবাবু |”

কালীকান্তবাবু যখন শ্বশুরবাড়ী পৌঁছিলেন, তখন তাঁহার শ্বশুর অন্তঃপুরে। কিন্তু বাহিরে একটা গণ্ডগোল উঠিল। দ্বারবান্ রামদীন্ পাঁড়ে বলিতেছে, “আরে ও খানসামাজি, তোম হুঁয়া মৎ বইঠিও-তোম হামারা পাশ আও |” শুনিয়া রামা গরম হইয়া, চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিতেছে, “যা বেটা মেড়ুয়াবাদী যা-তোর আপনার কাজ করগে |”

দ্বারবান্ পোর্টমাণ্টো নামাইয়া নিল। কালীকান্ত বলিল, “দরওয়ানজি, বাবুকে অমন করিয়া অপমান করিও না। উনি রাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন |”

দ্বারবান্ জামাইবাবুকে চিনিত, খানসামাকে চিনিত না। কালীকান্তের মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া মনে করিল, যেখানে জামাইবাবুই ইহাকে বাবু বলিতেছেন, সেখানে ইনি কোন ছদ্মবেশী বড় লোক হইবেন। দ্বারবান্ তখন ভক্তিভাবে রামাকে যুক্তকরে আশীর্ব্বাদ করিয়া কহিল, “গোলামকি কসুর মাপ কিজিয়ে!” রামা কহিল, “আচ্ছা, তামাকু ভেজ দেও!”

শ্বশুরবাড়ীর খানসামা উদ্ধব, অতি প্রাচীন পুরাতন ভৃত্য। সেই বাঁধা হুঁকায় তামাকু সাজিয়া আনিল। রামা, তাকিয়ায় হেলান দিয়া, তামাকু খাইতে লাগিল। কালীকান্ত চাকরদের ঘরে গিয়া, কলিকায় তামাকু খাইতে লাগিল। উদ্ধব বিস্মিত হইয়া কহিল, “দাদা ঠাকুর, এ কি এ?” কালীকান্ত কহিল, “ওঁর সাক্ষাতে কি তামাকু খাইতে পারি?”

উদ্ধব গিয়া অন্তঃপুরে কর্ত্তাকে সংবাদ দিল “জামাইবাবু আসিয়াছেন, তাঁহার সঙ্গে একজন কে ছদ্মবেশী মহাশয় এসেছেন-জামাইবাবু তাঁকে বড় মানেন, তাঁর সাক্ষাতে তামাকু পর্য্যন্ত খান না |”

কর্ত্তা নীলরতনবাবু শীঘ্র বহির্ব্বাটীতে আসিলেন। কালীকান্ত তাঁহাকে দেখিয়া দূর হইতে একটি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া সরিয়া গেল। রামা আসিয়া নীলরতনের পায়ের ধূলা লইয়া কোলাকুলি করিল। নীলরতন ভাবিল, “সঙ্গের লোকটা সভ্যভব্য বটে-তবে জামাই বাবাজিকে কেমন কেমন দেখিতেছি |”

নীলরতনবাবু রামাকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিতে বসিলেন, কিন্তু কথাবার্ত্তা শুনিয়া কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। এদিকে অন্তঃপুর হইতে জলযোগের স্থান হইয়াছে বলিয়া পরিচারিকা কালীকান্তকে ডাকিতে আসিল। কালীকান্ত বলিল, “বাপ রে, আমি কি বাবুর আগে জল খেতে পারি‌! আগে বাবুকে জল খাওয়াও। তার পর আমার হবে এখন। আমি, মাঠাকরুণ, আপনাদের খাচ্চিই ত |”

“মাঠাকরুণ” শুনিয়া পরিচারিকা মনে করিল, “জামাইবাবু আমাকে একজন শাশুড়ী টাশুড়ী মনে করিয়াছেন-না করবেন কেন; আমাকে ভাল মানুষের মেয়ে বই ত আর ছোট লোকের মেয়ের মত দেখায় না। ওঁরা দশটা দেখেছেন-মানুষ চিন্‌তে পারেন-কেবল এই বাড়ীর পোড়া লোকেই মানুষ চেনে না |” অতএব বিন্দী চাকরাণী জামাইবাবুর উপর বড় খুসী হইয়া অন্তঃপুরে গিয়া বলিল, “জামাইবাবুর বিবেচনা ভাল-সঙ্গের মানুষটি না খেলে কি তিনি খেতে পারেন-তা আগে তাঁকে জল খাওয়াও, তবে জামাই খাবেন |”