দেবী চৌধুরাণী
তখন সাগরকে নির্জনে পাইয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “সাগর! তুমি কেন এমন প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে?”
মুখে অঞ্চল দিয়া–এবার ঢাকাই রুমাল নহে–কাপড়ের যেখানটা হাতে উঠিল, সেইখানটা মুখে ঢাকা দিয়া সাগর কাঁদিল–সেই মুখরা সাগর টিপিয়া টিপিয়া, কাঁপিয়া কাঁপিয়া চুপি চুপি ভারি কান্না কাঁদিল। চুপি চুপি–পাছে দেবী শোনে।
কান্না থামিলে ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “সাগর! তুমি আমায় ডাকিলে না কেন? ডাকিলেই সব মিটিয়া যাইত।”
সাগর কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া, চক্ষু মুছিয়া বলিল, “কপালের ভোগ, কিন্তু আমি নাই ডাকিয়াছি–তুমিই বা আসিলে না কেন?”
ব্র। তুমি আমায় তাড়াইয়া দিয়াছিলে –না ডাকিলে যাই কি বলিয়া?
এই সকল কথাবার্তা যথাশাস্ত্র সমাপন হইলে ব্রজেশ্বর বলিল, “সাগর! তুমি ডাকাইতের সঙ্গে কেন আসিলে?”
সাগর বলিল, “দেবী–সম্বন্ধে আমার ভগিনী হয়, পূর্বে জানাশুনা ছিল। তুমি চলিয়া আসিলে, সে গিয়া আমার বাপের বাড়ী উপস্থিত হইল। আমি কাঁদিতেছি দেখিয়া সে বলিল, কাঁদ কেন ভাই–তোমার শ্যামচাঁদকে আমি বেঁধে এনে দিব। আমার সঙ্গে দুই দিনের তরে এসো।’ তাই আমি আসিলাম। দেবীকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিবার আমার বিশেষ কারণ আছে। তোমার সঙ্গে আমি পলাইয়া চলিলাম, এই কথা আমি চাকরাণীকে বলিয়া আসিয়াছি। তোমার জন্য এই সব আলবোলা, সট্কাা প্রভৃতি সাজাইয়া রাখিয়াছি–একবার তামাক-টামাক খাও, তার পর যেও।”
ব্রজেশ্বর বলিলেন, “কই, যে মালিক, সে ত কিছু বলে না।”
নিশিকে দেখিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “এখন আপনি ছিপ হুকুম করিলেই যাই।”
নি। ছিপ তোমারই। কিন্তু দেখ, তুমি রাণীর বোনাই–কুটুম্বকে স্বস্থানে পাইয়া আমরা আদর করিলাম না–কেবল অপমানই করিলাম, এ বড় দুঃখ থাকে। আমরা ডাকাইত বলিয়া আমাদের কি হিন্দুয়ানি নাই?
ব্র। কি করিতে বলেন?
নি। প্রথমে উঠিয়া ভাল হইয়া বসো।
নিশি মসনদ দেখাইয়া দিল। ব্রজেশ্বর শুধু গালিচায় বসিয়াছিল। বলিল, “কেন আমি বেশ বসিয়া আছি।”
তখন নিশি সাগরকে বলিল, “ভাই তোমার সামগ্রী তুমি তুলিয়া বসাও। জান, আমরা পরের দ্রব্য ছুঁই না।” হাসিয়া বলিল, “সোণা রূপা ছাড়া।”
ব্র। তবে আমি কি পিতল-কাঁসার দলে পড়িলাম।
নিশি। আমি ত তা মনে করি–পুরুষমানুষ স্ত্রীলোকের তৈজসের মধ্যে। না থাকিলে ঘর-সংসার চলে না–তাই রাখিতে হয়। কথায় কথায় সকড়ি হয়–মাজিয়া ঘষিয়া ধুইয়া ঘরে তুলিতে নিত্য প্রাণ বহিয়া যায়। নে ভাই সাগর, তোর ঘটি-বাটি তফাৎ কর–কি জানি, যদি সকড়ি হয়।
ব্র। একে ত পিতল কাঁসা–তার মধ্যে আবার ঘটি বাটি! ঘড়াটা গাড়ুটার মধ্যে গণ্য হইবারও যোগ্য নই?
নি। আমি ভাই বৈষ্ণবী, তৈজসের ধার ধারি না–আমাদের দৌড় মালসা পর্যন্ত। তৈজসের খবর সাগরকে জিজ্ঞাসা কর।
সা। আমি ঠিক কথা জানি। পুরুষমানুষ তৈজসের মধ্যে কলসী। সদাই অন্তঃশূন্য– আমরা যাই গুণবতী, তাই জল পুরিয়া পূর্ণকুম্ভ করিয়া রাখি।