রজনী
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমাদিগের বাড়ীতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া মধ্যে মধ্যে থাকিত। কেহ সন্ন্যাসী বলিত, কেহ ব্রহ্মচারী, কেহ দণ্ডী, কেহ অবধূত। পরিধানে গৈরিক বাস, কণ্ঠে রুদ্রাক্ষমালা, মস্তকে রুক্ষ কেশ, জটা নহে, রক্তচন্দনের ছোট রকমের ফোঁটা। বড় একটা ধূলাকাদার ঘটা নাই-সন্ন্যাসী জাতির মধ্যে ইনি একটু বাবু। খড়ম চন্দনকাষ্ঠের, তাহাতে হাতীর দাঁতের বৌল। তিনি যাই হউন, বালকেরা তাঁহাকে সন্ন্যাসী মহাশয় বলিত বলিয়া আমিও তাঁহাকে তাহাই বলিব।
পিতা কোথা হইতে তাঁহাকে লইয়া আসিয়াছিলেন। অনুভবে বুঝিলাম, পিতার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, সন্ন্যাসী নানাবিধ ঔষধ জানে এবং তান্ত্রিক যাগযজ্ঞে সুদক্ষ। বিমাতা বন্ধ্যা।
পিতার অনুকম্পায় সন্ন্যাসী উপরের একটি বৈঠকখানা আসিয়া দখল করিয়াছিল। ইহা আমার একটু বিরক্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল। আবার সন্ধ্যাকালে সূর্যের দিকে মুখ করিয়া সারঙ্গ রাগিণীতে আর্যাচ্ছন্দে স্তোত্র পাঠ করিত। ভণ্ডামী আর আমার সহ্য হইল না। আমি তাহার অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা করিবার জন্য তাহার নিকট গেলাম। বলিলাম, “সন্ন্যাসী ঠাকুর, ছাদের উপর মাথা মুণ্ড কি বকিতেছিলে?”
সন্ন্যাসী হিন্দুস্থানী, কিন্তু আমাদিগের সঙ্গে যে ভাষায় কথা কহিত, তাহার চৌদ্দ আনা নিভাঁজ সংস্কৃত, এক আনা হিন্দি, এক আনা বাঙ্গালা। আমি বাঙ্গালাই রাখিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর উত্তর করিলেন, “কেন, কি বকি, আপনি কি জানেন না?”
আমি বলিলাম, “বেদমন্ত্র?”
স। হইলে হইতে পারে।
আমি। পড়িয়া কি হয়?
স। কিছু না।
উত্তরটুকু সন্ন্যাসীর জিত-আমি এটুকু প্রত্যাশা করি নাই। তখন জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে পড়েন কেন?”
স। কেন, শুনিতে কি কষ্টকর?
আমি। না, শুনিতে মন্দ নয়, বিশেষ আপনি সুকণ্ঠ। তবে যদি কিছু ফল নাই তবে পড়েন কেন?
স। যেখানে ইহাতে কাহারও কোন অনিষ্ট নাই, সেখানে পড়ায় ক্ষতি কি?
আমি জারি করিতে আসিয়াছিলাম, -কিন্তু দেখিলাম যে, একটু হটিয়াছি-সুতরাং আমাকে চাপিয়া ধরিতে হইল। বলিলাম, “ক্ষতি নাই, কিন্তু নিষ্ফলে কেহ কোন কাজ করে না-যদি বেদগান নিষ্ফল, তবে আপনি বেদগান করেন কেন?”
স। আপনিও ত পণ্ডিত, আপনিই বলুন দেখি, বৃক্ষের উপর কোকিল গান করে কেন?
ফাঁপরে পড়িলাম। ইহার দুইটি উত্তর আছে, এক-“ইহাতেই কোকিলের সুখ”-দ্বিতীয়, “স্ত্রীকোকিলকে মোহিত করিবার জন্য |” কোন্টি বলি? প্রথমটি আগে বলিলাম, “গাইয়াই কোকিলের সুখ |”
স। গাইয়াই আমার সুখ।
আমি। তবে টপ্পা, খিয়াল প্রভৃতি থাকিতে বেদগান করেন কেন?
স। কোন্ কথাগুলি সুখকর-সামান্যা গণিকাগণের কদর্য চরিত্রের গুণগান সুখকর, না দেবতাদিগের অসীম মহিমাগান সুখকর?
হারিয়া, দ্বিতীয় উত্তরে গেলাম। “কোকিল গায়, কোকিলপত্নীকে মোহিত করিবার জন্য। মোহনার্থ যে শারীরিক স্ফূর্তি, তাহাতে জীবের সুখ। কণ্ঠস্বরের স্ফূর্তি সেই শারীরিক স্ফূর্তির অন্তর্গত। আপনি কাহাকে মুগ্ধ করিতে চাহেন?”