রজনী
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
তিনি আমাকে নানা প্রকারে অনুরোধ করিলেন,-রজনীকে বিবাহ করিতেই হইবে। নহিলে সপরিবারে মারা যাইব-খাইব কি? তাঁহার দু:খ ও কাতরতা দেখিয়া আমার দু:খ হইল না। বড় রাগ হইল। আমি রাগ করিয়া চলিয়া গেলাম।
পিতার কাছে হইতে গিয়া, আমার মার হাতে পড়িলাম। পিতার কাছে রাগ করিলাম, কিন্তু মার কাছে রাগ করিতে পারিলাম না-তাঁহার চক্ষের জল অসহ্য হইল। সেখান হইতে পলাইলাম। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা স্থির রহিল-যে রজনীকে দয়া করিয়া গোপালের সঙ্গে বিবাহিত করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলাম-আজি তাহার টাকার লোভে তাহাকে স্বয়ং বিবাহ করিব?
বিপদে পড়িয়া মনে করিলাম, ছোট মার সাহায্য লইব। গৃহের মধ্যে ছোট মাই বুদ্ধিমতী। ছোট মার কাছে গেলাম।
“ছোট মা, আমাকে কি রজনীকে বিবাহ করিতে হইবে? আমি কি অপরাধ করিয়াছি?”
ছোট মা চুপ করিয়া রহিলেন।
আমি। তুমিও কি ঐ পরামর্শে?
ছোট মা। বাছা, রজনী ত সৎকায়স্থের মেয়ে?
আমি। হইলই বা?
ছোট মা। আমি জানি, সে সচ্চরিত্রা।
আমি। তাহাও স্বীকার করি।
ছোট মা। সে পরম সুন্দরী।
আমি। পদ্মচক্ষু!
ছোট মা। বাবা-যদি পদ্মচক্ষুই খোঁজ, তবে তোমার আর একটা বিবাহ করিতে কতক্ষণ?
আমি। সে কি মা! রজনীর টাকার জন্য রজনীকে বিবাহ করিয়া, তার বিষয় লইয়া, তার পর তাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া আর একজনকে বিবাহ করা, কেমন কাজটা হইবে?
ছোট মা। ঠেলিয়া ফেলিবে কেন? তোমার বড় মা কি ঠেলা আছেন?
এ কথার উত্তর ছোট মার কাছে করিতে পারা যায় না। তিনি আমার পিতার দ্বিতীয় পক্ষের বনিতা, বহুবিবাহের দোষের কথা তাঁহার সাক্ষাতে কি প্রকারে বলিব! সে কথা না বলিয়া, বলিলাম, “আমি এ বিবাহ করিব না-তুমি আমায় রক্ষা কর। তুমি সব পার |”
ছোট মা। আমি না বুঝি, এমন নহে। কিন্তু বিবাহ না করিলে, আমরা সপরিবারে অন্নাভাবে মারা যাইব। আমি সকল কষ্ট সহ্য করিতে পারি, কিন্তু তোমাদিগের অন্নকষ্ট আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না। তোমার সহস্র বৎসর পরমায়ু হউক, তুমি ইহাতে অমত করিও না।
আমি। টাকাই কি এত বড়?
ছোট মা। তোমার আমার কাছে নহে। কিন্তু যাহারা তোমার আমার সর্বস্ব, তাঁহাদের কাছে বটে। সুতরাং তোমার আমার কাছেও বটে! দেখ, তোমার জন্য আমরা তিন জনে প্রাণ দিতেও পারি। তুমি আমাদিগের জন্য একটি অন্ধ কন্যা বিবাহ করিতে পারিবে না?
ছোট মাও দম্ভ করিয়া বলিলেন, “তুমিও যাই বল না কেন, আমি যদি কায়েতের মেয়ে হই, তবে তোমার এ বিবাহ দিবই দিব |”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “তবে বোধ হয়, তুমি গোয়ালার মেয়ে। আমায় এ বিবাহ দিতে পারিবে না |”
ছোট মা বলিলেন, “না বাবা, আমি কায়েতের মেয়ে |”
ছোট মা বড় দুষ্ট। আমাকে বাবা বলিয়া গালি ফিরাইয়া দিলেন।