দেবী চৌধুরাণী
ব্রজেশ্বরের তখন বড় রাগ ছিল–রাগে পা টানিয়া লইলেন। রাগের সময় শারীরিক ক্রিয়া সকল বড় জোরে জোরে হয়, আর হাত-পায়ের গতিও ঠিক অভিমতরূপ হয় না। একটা করিতে বিকৃতি জন্য আর একটা হইয়া পড়ে। সেই কারণে, আর কতকটা সাগরের ব্যস্ততার কারণ, পা সরাইয়া লইতে প্রমাদ ঘটিল। পা একটু জোরে সাগরের গায়ে লাগিল। সাগর মনে করিল, স্বামী রাগ করিয়া আমাকে লাথি মারিলেন। সাগর স্বামীর পা ছাড়িয়া দিয়া কুপিত ফণিনীর ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিল। বলিল, “কি? আমায় লাথি মারিলে?”
বাস্তবিক ব্রজেশ্বরের লাথি মারিবার ইচ্ছা ছিল না, –তাই বলিলেই মিটিয়া যাইত। কিন্তু একে রাগের সময়, আবার সাগর চোখ-মুখ ঘুরাইয়া দাঁড়াইল, –ব্রজেশ্বরের রাগ বাড়িয়া গেল। বলিলেন, “যদি মারিয়াই থাকি? তুমি না হয় বড়মানুষের মেয়ে, কিন্তু পা আমার–তোমার বড়মানুষ বাপও এ পা একদিন পূজা করিয়াছিলেন।”
সাগর রাগে জ্ঞান হারাইল। বলিল, “ঝক্মায়রি করিয়াছিলেন। আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করিব।”
ব্র। পালটে লাথি মারবে না কি?
সা। আমি তত অধম নহি। কিন্তু আমি যদি ব্রাহ্মণের মেয়ে হই, তবে তুমি আমার পা–সাগরের কথা ফুরাইতে না ফুরাইতে পিছনের জানালা হইতে কে বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”
সাগরের মুখে সেই রকম কি কথা আসিতেছিল। সাগর না ভাবিয়া চিন্তিয়া, পিছন ফিরিয়া না দেখিয়া রাগের মাথায় সেই কথাই বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”
ব্রজেশ্বরও রাগে সপ্তমে চড়িয়া কোন দিকে না চাহিয়া বলিল, “আমারও সেই কথা। যত দিন আমি তোমার পা টিপিয়া দিই, তত দিন আমিও তোমার মুখ দেখিব না। যদি আমার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, তবে আমি অব্রাহ্মণ।”
তখন রাগে রাগে তিনটা হইয়া ফুলিয়া ব্রজেশ্বর চলিয়া গেল। সাগর পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। এমন সময়ে সাগর যে ঘরে বসিয়া কাঁদিতেছিল, সেই ঘরে একজন পরিচারিকা, ব্রজেশ্বর গেলে পর সাগরের কি অবস্থা হইয়াছে, ইহা দেখিবার অভিপ্রায়ে ভিতরে প্রবেশ করিল, ছুতানাতা করিয়া দুই একটা কাজ করিতে লাগিল। তখন সাগরের মনে পড়িল যে, জানালা হইতে কে কথা কহিয়াছিল। সাগর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই জানেলা হইতে কথা কহিয়াছিলি?”
সে বলিল, “কই না?”
সাগর বলিল, “তবে কে জানেলায় দেখ্ ত।”
তখন সাক্ষাৎ ভগবতীর মত রূপবতী ও তেজস্বিনী একজন স্ত্রীলোক ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। সে বলিল, “জানালায় আমি ছিলাম।”
সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে গা?”
তখন সে স্ত্রীলোক বলিল, “তোমরা কি কেউ আমায় চেন না?”
সাগর বলিল, “না–কে তুমি?” তখন সেই স্ত্রীলোক উত্তর করিল, “আমি দেবী চৌধুরাণী।”
পরিচারিকার হাতে পানের বাটা ছিল, ঝন্ ঝন্ করিয়া পড়িয়া গেল। সেও কাঁপিতে কাঁপিতে আঁ–আঁ–আঁ–আঁ শব্দ করিতে করিতে বসিয়া পড়িল। কাঁকালের কাপড় খসিয়া পড়িল।
দেবী চৌধুরাণী তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, “চুপ রহো, হারামজাদি! খাড়া রহো।”
পরিচারিকা কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিয়া স্তম্ভিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। সাগরেরও গায়ে ঘাম দিতেছিল। সাগরের মুখেও কথা ফুটিল না। যে নাম তাহাদের কাণে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা ছেলে বুড়ো কে না শুনিয়াছিল? সে নাম অতি ভয়ানক।
কিন্তু সাগর আবার ক্ষণেক পরে হাসিয়া উঠিল। তখন দেবী চৌধুরাণীও হাসিল।