মৃণালিনী
গি। কেন? তিনি কি সেখানে নাই?
মৃ। সেইখানেই আছেন। কিন্তু তুমি ত জান যে, আমার সহিত এক বৎসর অসাক্ষাৎ তাঁহার ব্রত। আমি কি সে ব্রত ভঙ্গ করাইব?
গিরিজায়া নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী আবার কহিলেন, “আর কি বলিয়াই বা তাঁহার নিকট দাঁড়াইব। আমি কি বলিব যে, হৃষীকেশের উপর রাগ করিয়া আসিয়াছি, না, বলিব যে, হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছে?”
গিরিজায়া ক্ষণেক নীবর থাকিয়া কহিল, “তবে কি নদীয়ায় তোমার সঙ্গে হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না?”
মৃ। না।
গি। তবে যাইতেছ কেন?
মৃ। তিনি আমাকে দেখিতে পাইবেন না। কিন্তু আমি তাঁহাকে দেখিব। তাঁহাকে দেখিতেই যাইতেছি।
গিরিজায়ার মুখে হাসি ধরিল না। বলিল, “তবে আমি গীত গাই,
চরণতলে দিনু হে শ্যাম পরাণ রতন।
দিব না তোমারে নাথ মিছার যৌবন ||
এ রতন সমতুল, ইহা তুমি দিবে মূল,
দিবানিশি মোরে নাথ দিবে দরশন ||
ঠাকুরাণি, তুমি তাঁহাকে দেখিয়া ত জীবধারণ করিবে। আমি তোমার দাসী হইয়াছি, আমার ত তাহাতে পেট ভরিবে না, আমি কি খেয়ে বাঁচিব?”
মৃ। আমি দুই একটি শিল্পকর্ম জানি। মালা গাঁথিতে জানি, চিত্র করিতে জানি, কাপড়ের ফুল তুলিতে জানি। তুমি বাজারে আমার শিল্পকর্ম বিক্রয় করিয়া দিবে।
গিরি। আর আমি ঘরে ঘরে গীত গায়িব। “মৃণাল অধমে” গাইব কি?
মৃণালিনী অর্ধহাস্য, অর্ধ সকোপ দৃষ্টিতে গিরিজায়ার প্রতি কটাক্ষ করিলেন।
গিরিজায়া কহিল, “অমন করিয়া চাহিলে আমি গীত গায়িব |” এই বলিয়া গায়িল,
“সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।
কে আছে কাণ্ডারী হেন কে যাইবে সঙ্গে ||”
মৃণালিনী কহিল, “যদি এত ভয়, তবে একা এলে কেন?”
গিরিজায়া কহিল, “আগে কি জানি |” বলিয়া গায়িতে লাগিল,
“ভাস্ল তরী সকাল বেলা, ভাবিলাম এ জলখেলা,
মধুর বহিবে বায়ু ভেসে যাব রঙ্গে।
এখন - গগনে গরজে ঘন, বহে খর সমীরণ,
কূল ত্যজি এলাম কেন, মরিতে আতঙ্গে ||”
মৃণালিনী কহিল, “কূলে ফিরিয়া যাও না কেন?”
গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,
“মনে করি কূলে ফিরি, বাহি তরী ধীরি ধীরি
কূলেতে কণ্টক-তরু বেষ্টিত ভুজঙ্গে |”