সীতারাম
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
যে দিন রমা মরিল, সে দিন সীতারাম আর চিত্তবিশ্রামে গেলেন না। এখনও তত দূর হয় নাই। যখন সীতারাম রাজা না হইয়াছিলেন, তখন আবার শ্রীকে না দেখিয়াছিলেন, তখন সীতারাম রমাকে বড় ভালবাসিতেন--নন্দার অপেক্ষাও ভালবাসিতেন। সে ভালবাসা গিয়াছিল। কিসে গেল, সীতারাম তাহার চিন্তা কখনও করেন নাই। আজ একটু ভাবিলেন। ভাবিয়া দেখিলেন--রমার দোষ বড় বেশী নয়,--দোষ তাঁর নিজের। মনে মনে আপনার উপর বড় অসন্তুষ্ট হইলেন।
কাজেই মেজাজ খারাব হইয়া উঠিল। চিত্ত প্রফুল্ল করিবার জন্য শ্রীর কাছে যাইতে প্রবৃত্তি হইল না; কেন না, শ্রীর সঙ্গে এই আত্মগ্লানির বড় নিকট সম্বন্ধ; রমার প্রতি তাঁহার নিষ্ঠুরাচরণের কারণই শ্রী। শ্রীর কাছে গেলে আগুন আরও বাড়িবে। তাই শ্রীর কাছে না গিয়া রাজা নন্দার কাছে গেলেন। কিন্তু নন্দা সে দিন একটা ভুল করিল। নন্দা বড় চটিয়াছিল। ডাকিনীই হউক আর মানুষীই হউক, কোন পাপিষ্ঠার জন্য যে রাজা নন্দাকে অবহেলা করিতেন, নন্দা তাহাতে আপনার মনকে রাগিতে দেয় নাই। কিন্তু রমাকে এত অবহেলা করায়, রমা যে মরিল, তাহাতে রাজার উপর নন্দার রাগ হইল; কেন না, আপনার অপমানও তাহার সঙ্গে মিশিল। রাগটা এত বেশী হইল যে, অনেক চেষ্টা করিয়াও নন্দা সকলটুকু লুকাইতে পারিল না।
রমার প্রসঙ্গ উঠইলে, নন্দা বলিল, “মহারাজ! তুমিই রমার মৃত্যুর কারণ |”
নন্দা এইটুকু মাত্র রাগ প্রকাশ করিল, আর কিছুই না। কিন্তু তাহাতেই আগুন জ্বলিল; কেন না, ইন্ধন প্রস্তুত। একে ত আত্মগ্লানিতে সীতারামের মেজাজ খারাব হইয়াছিল--কোন মতে আপনার নিকটে আপনার সাফাই করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তাহার উপর নন্দার এই উচিত তিরস্কার শেলের মত বিঁধিল। “মহারাজ! তুমিই রমার মৃত্যুর কারণ |” শুনিয়া রাজা গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “ঠিক কথা। আমি তোমাদের মৃত্যুর কারণ। আমি প্রাণপাত করিয়া, আপনার রক্তে পৃথিবী ভাসাইয়া তোমাদিগকে রাজরাণী করিয়াছি--কাজেই এখন বলবেি বৈ কি, আমিই তোমাদের মৃত্যুর কারণ। যখন রমা গঙ্গারামকে ডাকিয়া আমার মৃত্যুর কারণ হইবার চেষ্টা করিয়াছিল, কৈ তখন ত কেহ কিছু বল নাই?”
এই বলিয়া রাজা রাগ করিয়া বহির্বাটীতে গেলেন। সেখানে চন্দ্রচূড় ঠাকুর, রাজাকে রমার জন্য শোকাকুল বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিবার জন্য নানা প্রকার আলাপ করিতে লাগিলেন। রাজার মেজাজ তপ্ত তেলের মত ফুটিতেছিল, রাজা তাঁহার কথার বড় উত্তর করিলেন না। চন্দ্রচূড় ঠাকুরও একটা ভুল করিলেন। তিনি মনে করিলেন, রমার মৃত্যুর জন্য রাজার অনুতাপ হইয়াছে, এই সময়ে চেষ্টা করিলে যদি ডাকিনী হইতে মন ফিরে, তবে সে চেষ্টা করা উচিত। তাই চন্দ্রচূড় ঠাকুর ভূমিকা করিবার অভিপ্রায়ে বলিলেন, “মহারাজ! আপনি যদি ছোট রাণীর প্রতি আর একটু মনোযোগী হইতেন, তা হইলে তিনি আরোগ্য লাভ করিতে পারিতেন |”
জ্বলন্ত আগুন এ ফুৎকারে আরও জ্বলিয়া উঠিল। রাজা বলিলেন, “আপনারও কি বিশ্বাস যে, আমিই ছোট রাণীর মৃত্যুর কারণ?”
চন্দ্রচূড়ের সেই বিশ্বাস বটে। তিনি মনে করিলেন, “এ কথা রাজাকে স্পষ্ট করিয়া বলাই উচিত। আপনার দোষ না দেখিলে, কাহারও চরিত্র শোধন হয় না। আমি ইঁহার গুরু ও মন্ত্রী, আমি যদি বলিতে সাহস না করিব, তবে কে বলিবে?” অতএব চন্দ্রচূড় বলিলেন, “তাহা এক রকম বলা যাইতে পারে |”
রাজা। পারে বটে। বলুন। কেবল বিবেচনা করুন, আমি যদি লোকের মৃত্যুকামনা করিতাম, তাহা হইলে এই রাজ্যে এক জনও এত দিন টিকিত না।