সীতারাম
কথা কহিতে কহিতে গঙ্গারাম কথা সমাপ্ত না করিয়া,-অতশয় ভীত হইয়া, “মহারাজ, রক্ষা কর! রক্ষা কর!” এই শব্দ করিয়া স্তম্ভিত বিহ্বলের মত হইয়া নীরব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সকলে দেখিল, গঙ্গারাম থর-থর কাঁপিতেছে। তখন সমস্ত জনমণ্ডলী সবিস্ময়ে সভয়ে চাহিয়া দেখিল-অপূর্বমূর্তি! জটাজুটবিলম্বী, গৈরিকধারিণী, জ্যোতির্ময়ী মূর্তি, সাক্ষাৎ সিংহবাহিনী দুর্গা তুল্য, ত্রিশূল হস্তে, গঙ্গারামকে ত্রিশূলাগ্রভাগে লক্ষ্য করিয়া, প্রখরগমনে তাহার অভিমুখে সভামণ্ডপ পার হইয়া আসিতেছে। দেখিবামাত্র সেই সাগরবৎ সংক্ষুব্ধ জনমণ্ডলী একেবারে নিস্তব্ধ হইল। গঙ্গারাম একদিন রাত্রিতে সে মূর্তি দেখিয়াছিল-আবার এই বিপৎকালে, যখন মিথ্যা প্রবঞ্চনার দ্বারা নিরপরাধিনী রমার সর্বনাশ করিতে সে উদ্যত, সেই সময়ে সেই মূর্তি দেখিয়া, চণ্ডী তাহাকে বধ করিতে আসিতেছেন বিবেচনা করিয়া, ভয়ে কাতর হইয়া “রক্ষা কর! রক্ষা কর!” শব্দ করিয়া উঠিল। এ দিকে রাজা, ও দিকে চন্দ্রচূড়, সেই রাত্রিদৃষ্ট দেবীতুল্য মূর্তি দেখিয়া চিনিলেন, এবং নগরের রাজলক্ষ্মী মনে করিয়া সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিলেন। তখন সভাস্থ সকলেই গাত্রোত্থান করিল।
জ কোন দিকে দৃষ্টি না করিয়া খরপদে গঙ্গারামের নিকট আসিয়া, গঙ্গারামের বক্ষে সেই মন্ত্রপূত ত্রিশূলাগ্রভাগ স্থাপন করিল। কথার মধ্যে কেবল বলিল, “এখন বল |”
ত্রিশূল গঙ্গারামের গাত্র স্পর্শ করিল মাত্র, তথাপি গঙ্গারামের শরীর হঠাৎ অবসন্ন হইয়া আসিল; গঙ্গারাম মনে করিল, আর একটি মিথ্যা কথা বলিলেই এই ত্রিশূল আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইবে। গঙ্গারাম তখন সভয়ে, বিনীতভাবে, সত্য বৃত্তান্ত সভাসমক্ষে বলিতে আরম্ভ করিল। যতক্ষণ তাহার কথা সমাপ্ত হইল, ততক্ষণ জয়ন্তী তাহার হৃদয় ত্রিশূলাগ্রভাগের দ্বারা স্পর্শ করিয়া রহিল। গঙ্গারাম তখন রমার নির্দোষিতা, আপনার মোহ, লোভ, ফৌজদারের সহিত সাক্ষাৎ, কথোপকথন এবং বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা সমুদয় সবিস্তারে কহিল।
জয়ন্তী তখন ত্রিশূল লইয়া খরপদে চলিয়া গেল। গমনকালে সভাস্থ সকলেই নতশিরে সেই দেবীতুল্য মূর্তিকে প্রণাম করিল। সকলেই ব্যস্ত হইয়া পথ ছাড়িয়া দিল। কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে বা তাহার অনুসরণ করিতে সাহস পাইল না। সে কোন দিকে কোথায় চলিয়া গেল, কেহ সন্ধান করিল না।
জয়ন্তী চলিয়া গেলে রাজা গঙ্গারামকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “এখন তুমি আপন মুখে সকল অপরাধ স্বীকৃত হইলে। এরূপ কৃতঘ্নের মৃত্যু ভিন্ন অন্য দণ্ড উপযুক্ত নহে। অতএব তুমি রাজদণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতে প্রস্তুত হও |”
গঙ্গারাম দ্বিরুক্তি করিল না। প্রহরীরা তাহাকে লইয়া গেল। বধদণ্ডের আজ্ঞা শুনিয়া সকল লোক স্তম্ভিত হইয়াছিল। কেহ কিছু বলিল না। নীরবে সকলে আপনার ঘরে ফিরিয়া গেল। গৃহে গিয়া সকলেই রমাকে “সাক্ষাৎ লক্ষ্মী” বলিয়া প্রশংসা করিল। রমার আর কোন কলঙ্ক রহিল না।