দেবী চৌধুরাণী
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ভবানী পাঠক বলিল, “এই ভাঙ্গা বাড়ীতে তুমি মোহর পাইয়াছ?”
প্র। আজ্ঞা হাঁ।
ভ। কত?
প্র। অনেক।
ভ। ঠিক বল কত। ভাঁড়াভাঁড়ি করিলে আমার লোক আসিয়া বাড়ী খুঁড়িয়া দেখিবে।
প্র। কুড়ি ঘড়া।
ভ। এ ধন লইয়া তুমি কি করিবে?
প্র। দেশে লইয়া যাইব।
ভ। রাখিতে পারিবে?
প্র। আপনি সাহায্য করিলে পারি।
ভ। এই বনে আমার পূর্ণ অধিকার। এই বনের বাহিরে আমার তেমন ক্ষমতা নাই। এ বনের বাহিরে ধন লইয়া গেলে, আমি রাখিতে পারিব না।
প্র। তবে আমি এই বনেই এই ধন লইয়া থাকিব। আপনি রক্ষা করিবেন?
ভ। করিব। কিন্তু তুমি এত ধন লইয়া কি করিবে?
প্র। লোকে ঐশ্বর্য লইয়া কি করে?
ভ। ভোগ করে।
প্র। আমিও ভোগ করিব।
ভবানী ঠাকুর “হোঃ হো!” করিয়া হাসিয়া উঠিল। প্রফুল্ল অপ্রতিভ হইল। দেখিয়া ভবানী বলিল, “মা! বোকা মেয়ের মত কথাটা বলিলে, তাই হাসিলাম। তোমার ত কেহই নাই বলিয়াছ, তুমি কাকে নিয়া এ ঐশ্বর্য ভোগ করিবে? একা কি ঐশ্বর্য ভোগ হয়?”
প্রফুল্ল অধোবদন হইল। ভবানী বলিতে লাগিল, “শোন। লোকে ঐশ্বর্য লইয়া কেহ ভোগ করে, কেহ পুণ্যসঞ্চয় করে, কেহ নরকের পথ সাফ করে। তোমার ভোগ করিবার যো নাই। কেন না, তোমার কেহ নাই। তুমি পুণ্যসঞ্চয় করিতে পার, না হয় নরকের পথ সাফ করিতে পার। কোন্টা করিবে?”
প্রফুল্ল বড় সাহসী। বলিল, “এ সকল কথা ত ডাকাইতের সর্দ্দারের মত নহে।”
ব্রা। না; আমি কেবল ডাকাইতের সর্দ্দার নহি। তোমার কাছে আর আমি ডাকাইতের সর্দ্দার নহি, তোমাকে আমি মা বলিয়াছি, সুতরাং আমি এক্ষণে তোমার পক্ষে ভাল যা, তাই বলিব। ধনের ভোগ তোমার হইতে পারে না–কেন না, তোমার কেহ নাই। তবে এই ধনের দ্বারা, বিস্তর পাপ, অথবা বিস্তর পুণ্য সঞ্চয় করিতে পার। কোন্ পথে যাইতে চাও?
প্র। যদি বলি, পাপই করিব?
ব্রা। আমি তাহা হইলে, লোক দিয়া, তোমার ধন তোমার সঙ্গে দিয়া তোমাকে এ বনের বাহির করিয়া দিব। এ বনে আমার অনুচর এমন অনেক আছে যে, তোমার এই ধনের লোভে তোমার সঙ্গে পাপাচরণ করিতে সম্মত হইবে। অতএব তোমার সে মতি হইলে, আমি তোমাকে এই দণ্ডে এখান হইতে বিদায় করিতে বাধ্য। এ বন আমারই।
প্র। লোক দিয়া আমার ধন আমার সঙ্গে পাঠাইয়া দেন, তবে সে আমার পক্ষে ক্ষতি কি?
ভ। রাখিতে পারিবে কি? তোমার রূপ আছে, যৌবন আছে, যদিও ডাকাইতের হাতে উদ্ধার পাও–কিন্তু রূপ-যৌবনের হাতে উদ্ধার পাইবে না। পাপের লালসা না ফুরাইতে ফুরাইতে ধন ফুরাইবে। যতই কেন ধন থাক না, শেষ করিলে শেষ হইতে বিস্তর দিন লাগে না। তার পর, মা?
প্র। তার পর কি?