সীতারাম
গঙ্গারাম যেন হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল। তাহার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, রমা কখনও এ সভামধ্যে আসিবে না বা সভায় সকল কথা বলিতে পারিবে না। গঙ্গারাম বলিল, “অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য। তাঁর কথায় যদি আমি দোষী হই, আমাকে সমুচিত দণ্ড দিবেন |”
রাজা অন্তঃপুর অভিমুখে দৃষ্টি করিলেন। তখন গঙ্গারাম সবিস্ময়ে দেখিল, অতি ধীরে ধীরে সশঙ্কিত শিশুর মত, এক মলিনবেশধারিণী অবগুণ্ঠনবতী রমণী সভামধ্যে আসিতেছে। যে রূপ গঙ্গারামের হাড়ে হাড়ে আঁকা, তাহা দেখিয়াই চিনিল। গঙ্গারাম বড় শঙ্কিত হইল। দর্শকমণ্ডলীমধ্যে মহা কোলাহল পড়িয়া গেল। শান্তিরক্ষকেরা তাহাদের থামাইল।
রমা আসিয়া আগে রাজাকে, পরে গুরু চন্দ্রচূড়কে দূর হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া, অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া সর্বসমক্ষে দাঁড়াইল--মলিন বেশেও রূপরাশি উছলিয়া পড়িতে লাগিল। চন্দ্রচূড় দেখিল, রাজা কথা কহিতে পারিতেছেন না--অধোবদনে আছেন। তখন চন্দ্রচূড় রমাকে বলিলেন, “মহারাণী! এই গঙ্গারামের বিচার হইতেছে। এ ব্যক্তি কখন আপনার অন্ত:পুরে গিয়াছিল কি না, গিয়া থাকে, তবে কেন গিয়াছিল, আপনার সঙ্গে কি কি কথা হইয়াছিল, সব স্বরূপ বলুন। রাজার আজ্ঞা, আর আমি তোমার গুরু, আমারও আজ্ঞা, সকল কথা সত্য বলিবে|”
রমা গ্রীবা উন্নত করিয়া গুরুকে বলিল, “রাজার রাণীতে কখনও মিথ্যা বলে না। আমরা যদি মিথ্যাবাদিনী হইতাম, তবে এই সিংহাসন এত দিন ভাঙ্গিয়া গুঁড়া হইয়া যাইত |”
দর্শকমণ্ডলী বাহির হইতে জয়ধ্বনি দিল--“জয় মহারাণীজিকী!”
রমা সাহস পাইয়া বলিতে লাগিল, “বলিব কি গুরুদেব! আমি রাজার মহিষী-রাজার ভৃত্য, আমার ভৃত্য--আমি যে আজ্ঞা করিব-রাজার ভৃত্য তা কেন পালন করিবে না? আমি রাজকার্যর জন্য কোতোয়ালকে ডাকিয়া পাঠিয়াছিলাম--কোতোয়াল আসিয়া আজ্ঞা শুনিয়া গিয়াছিল--তার আর বিচারই বা কেন, আমি বলিবই বা কি?”
কথা শুনিয়া দর্শকমণ্ডলী এবার আর জয়ধ্বনি করিল না--অনেকে বিষণ্ণ হইল-অনেকে বলিল, “কবুল |” চন্দ্রচূড় বলিলেন, “এমন কি রাজকার্য মা! যে রাত্রিতে কোতোয়ালকে ডাকিতে হয়?”
রমা তখন বলিল, “তবে সকল কথা শুনুন |” এই বলিয়া রমা দেখিল, পুত্র কোথা? পুত্র সুসজ্জিত হইয়া ধাত্রীক্রোড়ে। মুখ দেখিয়া সাহস পাইল। তখন রমা সবিশেষ বলিতে আরম্ভ করিল।
প্রথমে অতি ধীরে ধীরে, অতি দুরাগত সঙ্গীতের মত রমা বলিতে লাগিল--সকলে শুনিতে পাইল না। বাহিরের দর্শকমণ্ডলী বলিতে লাগিল, “মা! আমরা শুনিতে পাইতেছি না-আমরা শুনিব |” রমা আরও একটু স্পষ্ট বলিতে লাগিল। ক্রমে আরও স্পষ্ট-আরও স্পষ্ট। তার পর যখন রমা পুত্রের বিপদ শঙ্কায় এই সাহসের কাজ করিয়াছিল, এই কথা বুঝাইতে লাগিল--যখন একবার একবার চাঁদমুখ দেখিতে লাগিল, আর অশ্রুপরিপ্লুত হইয়া, মাতৃস্নেহের উচ্ছ্বাসের উপর উচ্ছ্বাস, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ তুলিতে লাগিল-তখন পরিষ্কার স্বর্গীয়, অপ্সরোনিন্দিত তিন গ্রাম সংমিলিত মনোমুগ্ধকর সঙ্গীতের মত শ্রোতৃগণের কানে সেই মুগ্ধকর বাক্য বাজিতে লাগিল। সকলে মুগ্ধ হইয়া শুনিতে লাগিল। তার পর সহসা রমা, ধাত্রীক্রোড় হইতে শিশুকে কাড়িয়া লইয়া সীতারামের পদতলে তাহাকে ফেলিয়া দিয়া, যুক্তকরে বলিতে লাগিল, “মহারাজ! আপনার আরও সন্তান আছে--আমার আর নাই! মহারাজ! আপনার রাজ্য আছে-আমার রাজ্য এই শিশু। মহারাজ! তোমার ধর্ম আছে, কর্ম আছে, যশ আছে, স্বর্গ আছে-আমি মুক্ত কণ্ঠে বলিতেছি, আমার ধর্ম এই, কর্ম এই, যশ এই, স্বর্গ এই-মহারাজ! অপরাধিনী হইয়া থাকি, তবে দণ্ড করুন__” শুনিয়া দর্শকমণ্ডলী অশ্রুপূর্ণ হইয়া পুনঃ পুনঃজয়ধ্বনি করিতে লাগিল। কিন্তু লোক ভাল মন্দ দুই রকমই আছে-অনেকেই জয়ধ্বনি করিতে লাগিল-কিন্তু আবার অনেকেই তাহাতে যোগ দিল না। জয়ধ্বনি ফুরাইলে তাহারা কেহ অর্ধস্ফুট স্বরে বলিল, “আমার ত এ কথায় বিশ্বাস হয় না |” কোন বর্ষীয়সী বলিল, “পোড়া কপাল! রাত্রে মানুষ ডাকিয়া নিয়া গিয়াছেন-উনি আবার সতী!” কেহ বলিল, “রাজা এ কথায় ভুলেন ভুলুন-আমরা এ কথায় ভুলিব না |” কেহ বলিল, “রাণী হইয়া যদি উনি এই কাজ করিবেন, তবে আমরা গরিবদুঃখীকি না করিব?”