সীতারাম
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যথাকালে, মহারাজ সীতারাম রায় সভাস্থলে সিংহাসনে গিয়া বসিলেন। নকিব স্তুতিবাদ করিল, কিন্তু গীত--বাদ্য সে দিন নিষেধ ছিল।
তখন শৃঙ্খলাবদ্ধ গঙ্গারাম সম্মুখে আনীত হইল। তাহাকে দেখিবার জন্য বাহিরে দণ্ডায়মান জনসমূহ বিচলিত ও উন্মুখ হইয়া উঠিল। শান্তিরক্ষকেরা তাহাদিগকে শান্ত করিল।
রাজা তখন গঙ্গারামকে গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “গঙ্গারাম! তুমি আমার কুটুম্ব, আত্মীয়, প্রজা এবং বেতনভোগী। আমি তোমাকে বিশেষ স্নেহ ও অনুগ্রহ করিতাম, তুমি বড় বিশ্বাসের পাত্র ছিলে, ইহা সকলেই জানে। একবার আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছি। তার পর, তুমি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিলে কেন? তুমি রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইবে |”
গঙ্গারাম বিনীতভাবে বলিল, “কোন শত্রুতে আপনার কাছে আমার মিথ্যাপবাদ দিয়াছে। আমি কোন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করি নাই। মহারাজ স্বয়ং আমার বিচার করিতেছেন--ভরসা করি, ধর্মশাস্ত্রসম্মত প্রমাণ না পাইলে আমার কোন দণ্ড করিবেন না |”
রাজা। তাহাই হইবে। ধর্মশাস্ত্রসম্মত যে প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা শুন, আর যথাসাধ্য উত্তর দাও।
এই বলিয়া রাজা চন্দ্রচূড়কে অনুমতি করিলেন, “আপনি যাহা জানেন, তাহা ব্যক্ত করুন |”
তখন চন্দ্রচূড় যাহা জানিতেন, তাহা সবিস্তারে সভামধ্যে বিবৃত করিলেন। তাহাতে সভাস্থ সকলেরই হৃদয়ঙ্গম হইল যে, যে দিন মুসলমান দুর্গ আক্রমণ করিবার জন্য নদী পার হইতেছিল, সে দিন চন্দ্রচূড়ের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও গঙ্গারাম দুর্গরক্ষার কোন চেষ্টা করেন নাই। চন্দ্রচূড়ের কথা সমাপ্ত হইলে, রাজা গঙ্গারামকে আজ্ঞা করিলেন, “নরাধম! ইহার কি উত্তর দাও?”
গঙ্গারাম যুক্তকরে বলিল, “ইনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, ইনি যুদ্ধের কি জানেন? মুসলমান এ পারে আসেও নাই, দুর্গ আক্রমণ করে নাই। যদি তাহা করিত, আর আমি তাহাদের না হঠাইতাম, তবে ঠাকুর মহাশয় যাহা বলিয়াছেন, তাহা শিরোধার্য হইত। মহারাজ! দুর্গমধ্যে আমিও বাস করি। দুর্গের বিনাশে আমার কি লাভ?”
রাজা। কি লাভ, তাহা আর এক জনের নিকট শুন।
এই বলিয়া রাজা চাঁদশাহ ফকিরকে আজ্ঞা করিলেন, “আপনি যাহা জানেন, তাহা বলুন |”
চাঁদশাহ তখন দুর্গ আক্রমণের পূর্ব রাত্রিতে তোরাব খাঁর নিকট গঙ্গারামের গমনবৃত্তান্ত যাহা জানিতেন, তাহা বলিলেন। রাজা তখন গঙ্গারামকে আজ্ঞা করিলেন, “ইহার কি উত্তর দাও?”
গঙ্গারাম বলিল, “আমি সে রাত্রে তোরাব খাঁর নিকট গিয়াছিলাম বটে। বিশ্বাসঘাতক সাজিয়া, কুপথে আনিয়া, তাহাকে গড়ের নীচে আনিয়া টিপিয়া মারিব--আমর এই অভিপ্রায় ছিল |”
রাজা। সে জন্য তোরাব খাঁর কাছে কিছু পুরস্কার প্রার্থনা করিয়াছিলে?
গ। নহিলে তাঁহার বিশ্বাস জন্মিবে কেন?
রাজা। কি পুরস্কার চাহিয়াছিলে?
গ। অর্ধেক রাজ্য।
রাজা। আর কিছু?
গ। আর কিছু না।
তখন রাজা চাঁদশাহ ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সে কথা কিছু জানেন?”