“তবে কি এ আমাদের তোপ!”

এই ভাবিয়া চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, একটি সিপাহীও গড় হইতে বাহির হয় নাই। দুর্গপ্রাকারে, যেখানে তোপ সকল সাজান আছে, সেখানে একটি মনুষ্যও নাই। তবে এ তোপ ছাড়িল কে?

কোনও দিকে ধূম দেখা যায় কি না, ইহা লক্ষ্য করিবার জন্য চন্দ্রচূড় চারি দিকে চাহিতে লাগিলেন,-দেখিলেন, গড়ের সম্মুখে যেখানে রাজবাটীর ঘাট, সেইখান হইতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ধূমরাশি আকাশমার্গে উঠিয়া পবন-পথে চলিয়া যাইতেছে।

তখন চন্দ্রচূড়ের স্মরণ হইল যে, ঘাটের উপরে, গাছের তলায় একটা তোপ আছে। কোন শত্রুর নৌকা আসিয়া ঘাটে না লাগিতে পারে, এ জন্য সীতারাম সেখানে একটা কামান রাখিয়াছিলেন-কেহ এখন সেই কামান ব্যবহার করিতেছে, ইহা নিশ্চিত। কিন্তু সে কে? গঙ্গারামের একটি সিপাহীও বাহির হয় নাই-এখনও ফটক বন্ধ। মৃণ্ময়ের সিপাহীরা অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে। মৃণ্ময় যে কোন সিপাহী ঐ কামানের জন্য রাখিয়া যাইবেন, ইহা অসম্ভব; কেন না, দুর্গরক্ষার ভার গঙ্গারামের উপর আছে। কোন বাজে লোক আসিয়া কামান ছাড়িল-ইহাও অসম্ভব; কেন না, বাজে লোকে গোলা-বারুদ কোথা পাইবে? আর এরূপ অব্যর্থ সন্ধান-বাজে লোকের হইতে পারে না-শিক্ষিত গোলন্দাজের। কার এ কাজ? চন্দ্রচূড় এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমন সময়ে আবার সেই কামান বজ্রনাদে চতুর্দিক শব্দিত করিল-আবার ধূমরাশি আকাশে উঠিয়া নদীর উপরিস্থ বায়ুস্তরে গগন বিচরণ করিতে লাগিল-আবার মুসলমান সিপাহীপরিপূর্ণ আর একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল।

“ধন্য! ধন্য!” বলিয়া চন্দ্রচূড় করতালি দিতে লাগিলেন। নিশ্চিত এই সেই মহাদেবী! বুঝি কালিকা সদয় হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছেন। জয় লক্ষ্মীনারায়ণজী! জয় কালী! জয় পুররাজলক্ষ্মী! তখন চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিলেন যে, যে সকল নৌকা অগ্রবর্তী হইয়াছিল-অর্থাৎ যে সকল নৌকার সিপাহীদের গুলি তীর পর্যন্ত পৌঁছিবার সম্ভাবনা, তাহারা তীর লক্ষ্য করিয়া বন্দুক চালাইতে লাগিল। ধূমে সহসা নদীবক্ষ অন্ধকার হইয়া উঠিল-শব্দে কান পাতা যায় না। চন্দ্রচূড় ভাবিলেন, “যদি আমাদের রক্ষক দেবতা হয়েন-তবে এ গুলিবৃষ্টি তাঁহার কি করিবে? আর যদি মনুষ্য হয়েন, তবে আমদের জীবন এই পর্যন্ত-এ লোহাবৃষ্টিতে কোন মনুষ্যই টিকিবে না |”

কিন্তু আবার সেই কামান ডাকিল-আবার দশ দিক্ কাঁপিয়া উঠিল-ধূমের চক্রে চক্রে ধূমাকার বাড়িয়া গেল। আবার সসৈন্য নৌকা ছিন্ন ভিন্ন হইয়া ডুবিয়া গেল।

তখন এক দিকে-এক কামান-আর এক দিকে শত শত মুসলমান সেনায় তুমুল সংগ্রাম বাধিয়া গেল। শব্দে আর কান পাতা যায় না। উপর্যুপরি গম্ভীর, তীব্র, ভীষণ, মুহুর্মুহুঃ ইন্দ্রহস্তপরিত্যক্ত বজ্রের মত, সেই কামান ডাকিতে লাগিল,-প্রশস্ত নদীবক্ষ এমন ধূমাচ্ছন্ন হইল যে, চন্দ্রচূড় সেই উচ্চ সৌধ হইতে উত্তালতরঙ্গসংক্ষুব্ধ ধূমসমুদ্র ভিন্ন আর কিছু দেখিতে পাইলেন না। কেবল সেই তীব্রনদী বজ্রনাদে বুঝিতে পারিলেন যে, এখনও হিন্দুধর্মরক্ষিণী দেবী জীবিতা আছেন। চন্দ্রচূড় তীব্রদৃষ্টিতে ধূমসমুদ্রের বিচ্ছেদ অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন-এই আশ্চর্য্য সমরের ফল কি হইল-দেখিবেন।

ক্রমে শব্দ কম পড়িয়া আসিল-একটু বাতাস উঠিয়া ধূঁয়া উড়াইয়া লইয়া গেল-তখন চন্দ্রচূড় সেই জলময় রণক্ষেত্র পরিষ্কার দেখিতে পাইলেন। দেখিলেন যে, ছিন্ন, নিমগ্ন নৌকা সকল স্রোতে উলটি পালটি করিয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। মৃত ও জীবিত সিপাহীর দেহে নদীস্রোত ঝটিকাশান্তির পর পল্লবকুসুমাকীর্ণ উদ্যানবৎ দৃষ্ট হইতেছে-কাহারও অস্ত্র, কাহারও বস্ত্র, কাহারও বাদ্য, কাহারও উষ্ণীষ, কাহারও দেহ ভাসিয়া যাইতেছে-কেহ সাঁতার দিয়া পলাইতেছে-কাহাকেও কুম্ভীরে গ্রাস করিতেছে। যে কয়খানা নৌকা ডোবে নাই-সে কয়খানা, নাবিকেরা প্রাণপাত করিয়া বাহিয়া সিপাহী লইয়া অপর পারে পলায়ন করিয়াছে। একমাত্র বজ্রের প্রহারে আহতা আসুরী সেনার ন্যায় মুসলমান সেনা রণে ভঙ্গ দিয়া পলাইল।

দেখিয়া চন্দ্রচূড় হাতজোড় করিয়া ঊর্ধ্বমুখে, গদ্গদকণ্ঠে, সজলনয়নে বলিলেন, “জয় জগদীশ্বর! জয় দৈত্যদমন, ভক্ততারণ, ধর্মরক্ষণ হরি! আজ বড় দয়া করিলে! আজ তুমি স্বয়ং সশরীরে যুদ্ধ করিয়াছ, নহিলে এই পুররাজলক্ষ্মী স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াছেন, নহিলে তোমার দাসানুদাস সীতারাম আসিয়াছে। তোমার সেই ভক্ত ভিন্ন এ যুদ্ধ মনুষ্যের সাধ্য নহে |”

তখন চন্দ্রচূড় প্রাসাদশিখর হইতে অবতরণ করিলেন।