একাদশ পরিচ্ছেদ

“এই ত বৈতরিণী! পার হইলে না কি সকল জ্বালা জুড়ায়! আমার জ্বালা জুড়াইবে কি?”

খরবাহিনী বৈতরিণী-সৈকতে দাঁড়াইয়া একাকিনী শ্রী এই কথা বলিতেছিল। পশ্চাৎ অতি দূরে নীলমেঘের মত নীলগিরির।2 শিখরপুঞ্জ দেখা যাইতেছিল; সম্মুখে নীলসলিলবাহিনী বক্রগামিনী তটিনী রজতপ্রস্তরবৎ বিস্তৃত সৈকতমধ্যে বাহিতা হইতেছিল; পারে কৃষ্ণপ্রান্তরনির্মিত সোপানাবলীর উপর সপ্ত মাতৃকার মণ্ডপ শোভা পাইতেছিল; তন্মধ্যে আসীনা সপ্ত মাতৃকার প্রস্তরময়ী মূর্তিও কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল; রাজ্ঞীশোভাসমন্বিতা ইন্দ্রাণী, মধুররূপিণী বৈষ্ণবী, কৌমারী, ব্রহ্মাণী, সাক্ষাৎ বীভৎসসরূপধারিণী যমপ্রসূতি ছায়া, নানালঙ্কারভূষিতা বিপুললোরুকরচরণোরসী কম্বুকণ্ঠান্দোলিতরত্নহারা লম্বোদরা চীনাম্বরা বরাহবদনা বারাহী, বিশুষ্কাস্থিচর্মমাত্রাবিশেষা পলিতকেশা নগ্নাবেশা চণ্ডমুণ্ডধারিণী ভীষণা চামুণ্ডা, রাশি রাশি কুসুম চন্দন বিল্বপত্রে প্রপীড়িতা হইয়া বিরাজ করিতেছে। তৎপশ্চাৎ বিষ্ণুমণ্ডপের উচ্চ চূড়া নীলাকাশে চিত্রিত; তৎপরে নীলপ্রস্তরের উচ্চস্তম্ভোপরি আকাশমার্গে খগপতি গুরুড় সমাসীন।3 অতিদূরে উদয়গিরির ও ললিতগিরির বিশাল নীল কলেবর আকাশপ্রান্তে শয়ান।4 এই সকলের প্রতি শ্রী চাহিয়া দেখিল; বলিল, “হায়! এই ত বৈতরিণী! পার হইলে আমার জ্বালা জুড়াইবে কি?”

“এ সে বৈতরিণী নহে-

যমদ্বারে মহাঘোরে তপ্তা বৈতরিণী নদী-

আগে যমদ্বারে উপস্থিত হও-তবে সে বৈতরিণী দেখিবে |”

পিছন হইতে শ্রীর কথার কেহ এই উত্তর দিল। শ্রী ফিরিয়া দেখিল, এক সন্ন্যাসিনী।

শ্রী বলিল, “ওমা! সেই সন্ন্যাসিনী! তা, মা, যমদ্বার বৈতরিণীর এ পারে, না ও পারে?”

সন্ন্যাসিনী হাসিল, বলিল, “বৈতরিণী পার হইয়া যমপুরে পৌঁছিতে হয়। কেন মা, এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে? তুমি এ পারেই কি যমযন্ত্রণা ভোগ করিতেছ?”

শ্রী। যন্ত্রণা বোধ হয় দুই পারেই আছে।

সন্ন্যাসিনী। না, মা, যন্ত্রণা সব এই পারেই। ও পারে যে যন্ত্রণার কথা শুনিতে পাও, সে আমরা এই পার হইতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই। আমাদের এ জন্মের সঞ্চিত পাপগুলি আমরা গাঁটরি বাঁধিয়া, বৈতরিণীর সেই ক্ষেয়ারীর ক্ষেয়ায় বোঝাই দিয়া, বিনা কড়িতে পার করিয়া লইয়া যাই। পরে যমালয়ে গিয়া গাঁটরি খুলিয়া ধীরে সুস্থে সেই ঐশ্বর্য্য একা একা ভোগ করি।

শ্রী। তা মা, বোঝাটা এ পারে রাখিয়া যাইবার কোন উপায় আছে কি? থাকে ত আমায় বলিয়া দাও, আমি শীঘ্র শীঘ্র উহার বিলি করিয়া বেলায় বেলায় পার হইয়া চলিয়া যাই, রাত করিবার দরকার দেখি না—

সন্ন্যা। এত তাড়াতাড়ি কেন মা? এখনও তোমার সকাল বেলা।

শ্রী। বেলা হলে বাতাস উঠিবে।

সন্ন্যাসিনীর আজিও তুফানের বেলা হয় নাই-বয়সটা কাঁচা রকমের। তাই শ্রী এই রকমের কথা কহিতে সাহস করিতেছিল। সন্ন্যাসিনীও সেই রকম উত্তর দিল, “তুফানের ভয় করি মা! কেন, তোমার কি তেমন পাকা মাঝি নাই?”

2- বালেশ্বর জেলার উত্তরভাগস্থিত কতকগুলি পর্বতকে নীলগিরি বলে। তাহাই কোন কোন স্থানে বৈতরিণীতীর হইতে দেখা যায়। এই গরুড়স্তম্ভ দেখিতে অতি চমৎকার।

3- *বালেশ্বর জেলার উত্তরভাগস্হিত কতকগুলি পর্বতকে বলে। তাহাই কোন কোন স্হানে বৈতরণীতীর্ইতে দেখা যায়। **এই গরুড়স্তম্ভ দেখিতে অতি চমৎকার।

4- পুরুষোত্তম যাইবার আধুনিক যে রাজপথ, এই সকল পর্বত, তাহার বামে থাকে। নিকট নহে।