কৃষ্ণকান্তের উইল
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
দ্বিতল অট্টালিকার উপরতলে রোহিণীর বাস–তিনি হাপ পরদানসীন। নিম্নতলে ভৃত্যগণ বাস করে। সে বিজনমধ্যে প্রায় কেহই কখনও গোবিন্দলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিত না–সুতরাং সেখানে বহির্বটীর প্রয়োজন ছিল না। যদি কালে ভদ্রে কোন দোকানদার বা অপর কেহ আসিত, উপরে বাবুর কাছে সংবাদ যাইত; বাবু নীচে আসিয়া তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতেন। অতএব বাবুর বসিবার জন্য নীচেও একটি ঘর ছিল।
নিম্নতলে দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া নিশাকর দাস কহিলেন, “কে আছ গা এখানে?”
গোবিন্দলালের সোণা রূপো নামে দুই ভৃত্য ছিল। মনুষ্যের শব্দ দুই জনেই দ্বারের নিকট আসিয়া নিশাকরকে দেখিয়া বিস্মিত হইল। নিশাকরকে দেখিয়াই বিশেষ ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হইল–নিশাকরও বেশভূষা সম্বন্ধে একটু জাঁক করিয়া গিয়াছেন। সেরূপ লোক কখনও সে চৌকাঠ মাড়ায় নাই–দেখিয়া ভৃত্যেরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল। সোণা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কাকে খুঁজেন?”
নি। তোমাদেরই। বাবুকে সংবাদ দাও যে, একটি ভদ্রলোক সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছে।
সো। নাম কি বলিব?
নি। নামেরই প্রয়োজন বা কি? একটি ভদ্রলোক বলিয়া বলিও।
এখন, চাকরেরা জানিত যে, কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে বাবু সাক্ষাৎ করেন না–সেরূপ স্বভাবই নয়। সুতরাং চাকরেরা সংবাদ দিতে বড় ইচ্ছুক ছিল না। সোণা ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। রূপো বলিল, “আপনি অনর্থক আসিয়াছেন–বাবু কাহারও সহিত সাক্ষাৎ করেন না |”
নিশা। তবে, তোমরা থাক–আমি বিনা সংবাদে উপরে যাইতেছি।
চাকরেরা ফাঁপরে পড়িল। বলিল, “না মহাশয়, আমাদের চাকরি যাবে |”
নিশাকর তখন একটি টাকা বাহির করিয়া বলিলেন, “যে সংবাদ করিবে, তাহার এই টাকা |”
সোণা ভাবিতে লাগিল–রূপো চিলের মত ছোঁ মারিয়া নিশাকরের হাত হইতে টাকা লইয়া উপরে সংবাদ দিতে গেল।
গৃহটি বেষ্টন করিয়া যে পুষ্পোদ্যান আছে, তাহা অতি মনোরম। নিশাকর সোণাকে বলিলেন, “আমি এ ফুলবাগানে বেড়াইতেছি–আপত্তি করিও না–যখন সংবাদ আসিবে, তখন আমাকে ঐখান হইতে ডাকিয়া আনিও|” বলিয়া নিশাকর সোণার হাতে আর একটি টাকা দিলেন।
রূপো যখন বাবুর কাছে গেল, তখন বাবু কোন কার্যবশতঃ অনবসর ছিলেন, ভৃত্য তাঁহাকে নিশাকরের সংবাদ কিছুই বলিতে পারিল না। এদিকে উদ্যান ভ্রমণ করিতে করিতে নিশাকর একবার ঊর্ধ্বদৃষ্টি করিয়া দেখিলেন, এক পরমা সুন্দরী জানেলায় দাঁড়াইয়া তাঁহাকে দেখিতেছে।
রোহিণী নিশাকরকে দেখিয়া ভাবিতেছিল, “এ কে? দেখিয়াই বোধ হইতেছে যে, এ দেশের লোক নয়। বেশভূষা রকম সকম দেখিয়া বোঝা যাইতেছে যে, বড় মানুষ বটে। দেখিতেও সুপুরুষ–গোবিন্দলালের চেয়ে? না, তা নয়। গোবিন্দলালের রঙ ফরশা–কিন্তু এর মুখ চোখ ভাল। বিশেষ চোখ–আ মরি! কি চোখ! এ কোথা থেকে এলো? হলুদগাঁয়ের লোক ত নয়–সেখানকার সবাইকে চিনি। ওর সঙ্গে দুটো কথা কইতে পারি না? ক্ষতি কি–আমি ত কখনও গোবিন্দলালের কাছে বিশ্বাসঘাতিনী হইব না |”
রোহিণী এইরূপ ভাবিতেছিল, এমত সময়ে নিশাকর উন্নতমুখে ঊর্ধ্বদৃষ্টি করাতে চারি চক্ষু সম্মিলিত হইল। চক্ষে চক্ষে কোন কথাবার্ত্তা হইল কি না, তাহা আমরা জানি না–জানিলেও বলিতে ইচ্ছা করি না–কিন্তু আমরা শুনিয়াছি, এমত কথাবার্তা হইয়া থাকে।