দেবী চৌধুরাণী
প্রফুল্লকে লইয়া বাহকেরা নিঃশব্দে চলিল বলিয়াছি; কেহ মনে না করেন–এটা ভ্রম-প্রমাদ! বাহকের প্রকৃতি শব্দ করা। কিন্তু এবার শব্দ করার পক্ষে তাহাদের প্রতি নিষেধ ছিল। শব্দ করিলে গোলযোগ হইবে; তা ছাড়া আর একটা কথা ছিল। ব্রহ্মঠাকুরাণীর মুখে শুনা গিয়াছে, বড় ডাকাতের ভয়। বাস্তবিক এরূপ ভয়ানক দস্যুভীতি কখনও কোন দেশে হইয়াছিল কি না সন্দেহ। তখন দেশ অরাজক। মুসলমানের রাজ্য গিয়াছে; ইংরেজের রাজ্য ভাল করিয়া পত্তন হয় নাই–হইতেছে মাত্র। তাতে আবার বছর কত হইল, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেশ ছারখার করিয়া গিয়াছে। তার পর আবার দেবী সিংহের ইজারা। পৃথিবীর ও পারে ওয়েষ্ট্ মিনষ্টর হলে দাঁড়াইয়া এদ্ম ন্দ্ বর্ক সেই দেবী সিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্বতোদ্গীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে বর্ক দেবী সিংহের দুর্বিষহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন। তাঁহার নিজমুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শোকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল–আজিও শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে শরীর লোমাঞ্চিত এবং হৃদয় উন্মত্ত হয়। সেই ভয়ানক অত্যাচার বরেন্দ্র-ভূমি ডুবাইয়া দিয়াছিল। অনেকেই কেবল খাইতে পায় না নয়, গৃহে পর্যন্ত বাস করিতে পায় না। যাহাদের খাইবার নাই, তাহারা পরের কাড়িয়া খায়। কাজেই এখন গ্রামে গ্রামে দলে দলে চোর ডাকাত। কাহার সাধ্য শাসন করে? গুড্ল্যা ড সাহেব রঙ্গপুরের প্রথম কালেক্টর। ফৌজদারী তাঁহারই জিম্মা। তিনি দলে দলে সিপাহী ডাকাত ধরিতে পাঠাইতে লাগিলেন। সিপাহীরা কিছুই করিতে পারিল না।
অতএব দুর্লভের ভয়, তিনি ডাকাতি করিয়া প্রফুল্লকে লইয়া যাইতেছেন, আবার তার উপর ডাকাতে না ডাকাতি করে। পাল্কী দেখিয়া ডাকাতের আসা সম্ভব। সেই ভয়ে বেহারারা নিঃশব্দ। গোলমাল হইবে বলিয়া সঙ্গে অপর লোকজনও নাই, কেবল দুর্লভ নিজে আর ফুলমণি। এইরূপে তাহারা ভয়ে ভয়ে চারি ক্রোশ ছাড়াইল।
তার পর ভারি জঙ্গল আরম্ভ হইল। বেহারারা সভয়ে দেখিল, দুই জন মানুষ সম্মুখে আসিতেছে। রাত্রিকাল–কেবল নক্ষত্রালোকে পথ দেখা যাইতেছে। সুতরাং তাহাদের অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। বেহারারা দেখিল, যেন কালান্তর যমের মত দুই মূর্ত্তি আসিতেছে। একজন বেহারা অপরদিগকে বলিল, “মানুষ দুটোকে সন্দেহ হয়!” অপর আর একজন বলিল, “রাত্রে যখন বেড়াচ্চে, তখন কি আর ভাল মানুষ?”
তৃতীয় বাহক বলিল, “মানুষ দুটো ভারি জোয়ান।”
৪র্থ। হাতে লাঠি দেখ্ছি না?
১ম। চক্রবর্ত্তী মহাশয় কি বলেন? আর তো এগোনো যায় না–ডাকাতের হাতে প্রাণটা যাবে।
চক্রবর্তী মহাশয় বলিলেন, “তাই ত বড় বিপদ্ দেখি যে! যা ভেবেছিলেম, তাই হলো!”
এমন সময়ে, যে দুই ব্যক্তি আসিতেছিল, তাহারা পথে লোক দেখিয়া হাঁকিল, “কোন্ হ্যায় রে?”
বেহারারা অমনি পাল্কী মাটিতে ফলিয়া দিয়া “বাবা গো” শব্দ করিয়া একেবারে জঙ্গলের ভিতর পলাইল। দেখিয়া দুর্লভ চক্রবর্তী মহাশয়ও সেই পথাবলম্বী হইলেন। তখন ফুলমণি “আমায় ফেলে কোথা যাও?” বলিয়া তাঁর পাছু পাছু ছুটিল।
যে দুই জন আসিতেছিল–যাহারা এই দশ জন মনুষ্যের ভয়ের কারণ–তাহারা পথিক মাত্র। দুই জন হিন্দুস্থানী দিনাজপুরের রাজসরকারে চাকরির চেষ্টায় যাইতেছে। রাত্রিপ্রভাত নিকট দেখিয়া সকালে সকালে পথ চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। বেহারারা পলাইল দেখিয়া তাহারা একবার খুব হাসিল। তাহার পর আপনাদের গন্তব্য পথে চলিয়া গেল। কিন্তু বেহারারা, আর ফুলমণি ও চক্রবর্তী মহাশয় আর পাছু ফিরিয়া চাহিল না।
প্রফুল্ল পাল্কীতে উঠিয়াই মুখের বাঁধন স্বহস্তে খুলিয়া ফেলিয়াছিল। রাত্রি দুই প্রহরে চীৎকার করিয়া কি হইবে বলিয়া চীৎকার করে নাই; চীৎকার শুনিতে পাইলেই বা কে ডাকাতের সম্মুখে আসিবে! প্রথমে ভয়ে প্রফুল্ল কিছু আত্মবিস্মৃত হইয়াছিল, কিন্তু এখন প্রফুল্ল স্পষ্ট বুঝিল যে, সাহস না করিলে মুক্তির কোন উপায় নাই। যখন বেহারারা পাল্কী ফেলিয়া পলাইল, তখন প্রফুল্ল বুঝিল–আর একটা কি নূতন বিপদ্। ধীরে ধীরে পাল্কীর কপাট খুলিল। অল্প মুখ বাড়াইয়া দেখিল, দুই জন মনুষ্য আসিতেছে। তখন প্রফুল্ল ধীরে ধীরে কপাট বন্ধ করিল; যে অল্প ফাঁক রহিল, তাহা দিয়া প্রফুল্ল দেখিল, মনুষ্য দুই জন চলিয়া গেল। তখন প্রফুল্ল পাল্কী হইতে বাহির হইল–দেখিল, কেহ কোথাও নাই।
প্রফুল্ল ভাবিল, যাহারা আমাকে চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছিল, তাহারা অবশ্য ফিরিবে। অতএব যদি পথ ধরিয়া যাই, তবে ধরা পড়িতে পারি। তার চেয়ে এখন জঙ্গলের ভিতর লুকাইয়া থাকি। তার পর, দিন হইলে যা হয় করিব।
এই ভাবিয়া প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল। ভাগ্যক্রমে যে দিকে বেহারারা পলাইয়াছিল, সে দিকে যায় নাই। সুতরাং কাহারও সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ হইল না। প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অল্পক্ষণ পরেই প্রভাত হইল।