কাজি সাহেব সেইরূপ হুকুম দিলেন। কামার আসিয়া গঙ্গারামের হাত মুক্ত করিল। কামার সেখানে উপস্থিত থাকিবার প্রয়োজন ছিল না, তবে সরকারী বেড়ী হাতকড়ি সব তাহার জিম্মা, সেই উপলক্ষে সে আসিয়াছিল। তাহার ভিতর কিছু গোপন কথাও ছিল। রাত্রিশেষে কর্মকার মহাশয় চন্দ্রচূড় ঠাকুরের কিছু টাকা খাইয়াছিলেন।

তখন ফকির বলিল, “আর বিলম্ব কেন? উহাকে গাড়িয়া ফেলিতে হুকুম দিন |”

শুনিয়া কামার বলিল, “বেড়ী পায়ে থাকিবে কি? সরকারী বেড়ী নোক্সারন হইবে কেন? এখন ভাল লোহা বড় পাওয়া যায় না। আর বদমায়েসেরও এত হুড়াহুড়ি পড়িয়া গিয়াছে যে, আমি আর বেড়ি যোগাইতে পারিতেছি না |” শুনিয়া কাজি সাহেব বেড়ী খুলিতে হুকুম দিলেন। বেড়ি খোলা হইল।

শৃঙ্খল-মুক্ত হইয়া গঙ্গারাম দাঁড়াইয়া একবার এদিক ওদিক দেখিল। তার পর গঙ্গারাম এক অদ্ভুত কাজ করিল। নিকটে সীতারাম ছিলেন; ঘোড়ার চাবুক তাঁহার হাতে ছিল। সহসা তাঁহার হাত হইতে সেই চাবুক কাড়িয়া লইয়া গঙ্গারাম এক লম্ফে সীতারামের শূন্য অশ্বের উপর উঠিয়া অশ্বকে দারুণ আঘাত করিল। তেজস্বী অশ্ব আঘাতে ক্ষিপ্ত হইয়া এক লম্ফে কবরের খাদ পার হইয়া সিপাহীদিগের উপর দিয়া চলিয়া গিয়া জনতার ভিতর প্রবেশ করিল।

যতক্ষণে একবার বিদ্যুৎ চমকে, ততক্ষণে এই কাজ সম্পন্ন হইল। দেখিয়া, সেই লোকারণ্যমধ্যে তুমুল হরিধ্বনি পড়িয়া গেল। সিপাহীরা “পাক‍‍ড়ো পাক‍‍ড়ো” বলিয়া পিছু পিছু ছুটিল। কিন্তু তাহাতে একটা ভারি গোলযোগ উপস্থিত হইল। বেগবান অশ্বের সম্মুখ হইতে লোকে ভয়ে সরিয়া যাইতে লাগিল, গঙ্গারাম পথ পাইতে লাগিল, কিন্তু সিপাহীরা পথ পাইল না। তাহাদের সম্মুখে লোক জমাট বাঁধিয়া দাঁড়াইল। তখন তাহারা হাতিয়ার চালাইয়া পথ করিবার উদ্যোগ করিল।

সেই সময়ে তাহার সবিস্ময়ে দেখিল যে, কালান্তক যমের ন্যায় কতকগুলি বলিষ্ঠ অস্ত্রধারী পুরুষ, একে একে ভিড়ের ভিতর হইতে আসিয়া সারি দিয়া তাহাদের সম্মুখে পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। তখন আরও সিপাহী আসিল। দেখিয়া আরও ঢাল-সড়কিওয়ালা হিন্দু আসিয়া তাহাদের পথ রোধ করিল। তখন দুই দলে ভারী দাঙ্গা উপস্থিত হইল।

দেখিয়া, সক্রোধে কাজি সাহেব সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি ব্যাপার?”

সী। আমি ত কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।

কা। বুঝিতে পারিতেছ না? আমি বুঝিতে পারিতেছি, এ তোমারই খেলা।

সী। তাহা হইলে আপনার কাছে নিরস্ত্র হইয়া মৃত্যুভিক্ষা চাহিতে আসিতাম না।

কা। আমি এখন তোমার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করিব। এ কবরে তোমাকেই পুঁতিব।

এই বলিয়া কাজি সাহেব কামারকে হুকুম দিলেন, “ইহারই হাতে পায়ে ঐ হাতকড়ি, বেড়ী লাগাও |” দ্বিতীয় ব্যক্তিকে তিনি ফৌজাদারের নিকট পাঠাইলেন-ফৌজদার সাহেব যাহাতে আরও সিপাহী লইয়া স্বয়ং আইসেন, এমন প্রার্থনা জানায়। ফৌজদারের নিকট লোক গেল। কামার আসিয়া সীতারামকে ধরিল। সেই বৃক্ষারূঢ়া বনদেবী শ্রী তাহা দেখিল।

এ দিকে গঙ্গারাম কষ্টে অথচ নির্বিঘ্নে অশ্ব লইয়া লোকারণ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কষ্টে-কেন না, আসিতে আসিতে দেখিলেন যে, সেই জনতামধ্যে একটা ভারী গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কোলাহল ভয়ানক হইল, লোকসকল সম্মুখে ছুটিতে লাগিল। তাঁহার অশ্ব এই সকলে অতিশয় ভীত হইয়া দুর্দমনীয় হইয়া উঠিল। অশ্বারোহণের কৌশল গঙ্গারাম তেমন জানিতেন না; ঘোড়া সামলাতেই তাঁহাকে এত ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল যে, তিনি আর কোন দিকে চাহিয়া দেখিতে পারিলেন না যে, কোথায় কি হইতেছে। কেবল “মার! মার!” একটা শব্দ কানে গেল।