শ্রী দিগন্তরে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, ঘোড়ার উপর কে আসিতেছে। যোদ্ধৃবেশ, অথচ নিরস্ত্র। অশ্বী বড় তেজস্বিনী, কিন্তু লোকের ভিড় ঠেলিয়া আগুইতে পারিতেছে না। অশ্বী নাচিতেছে, দুলিতেছে, গ্রীবা বাঁকাইতেছে, কিন্তু তবু বড় আগু হইতে পারিতেছে না। শ্রী চিনিলেন, অশ্বপৃষ্ঠে সীতারাম।

এ দিকে গঙ্গারামকে সিপাহীরা কবরে ফেলিতেছিল। সেই সময়ে দুই হাত তুলিয়া সীতারাম নিষেধ করিলেন। সিপাহীরা নিরস্ত হইল। শাহ সাহেব বলিলেন, “কিয়া দেখ‍‍তে হো! কাফেরকো মাট্টি দেও |”

কাজি সাহেব ভাবিলেন। কাজি সাহেবের সে সময়ে সেখানে আসিবার কোন প্রয়োজন ছিল না, কেবল জনতা শুনিয়া শখ করিয়া আসিয়াছিলেন। যখন আসিয়াছিলেন, তখন তিনিই কর্তা। তিনি বলিলেন, “সীতারাম যখন বারণ করিতেছে, তখন কিছু কারণ আছে। সীতারাম আসা পর্যন্ত বিলম্ব কর |”

শাহ সাহেব অসন্তুষ্ট হইলেন, কিন্তু অগত্যা সীতারাম পৌঁছান অপেক্ষা করিতে হইল। গঙ্গারামের মনে একটু আশার সঞ্চার হইল।

সীতারাম কাজি সাহেবের নিকট পৌঁছিলেন। অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক প্রণতমস্তকে শাহ সাহেবকে বিনয়পূর্বক অভিবাদন করিলেন। তৎপরে কাজি সাহেবকে তদ্রূপ করিলেন। কাজি সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন রায় সাহেব! আপনার মেজাজ সরিফ |”

সী। অলহম্- দল্-ইল্লা। মেজাজে মবারকের সংবাদ পাইলেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী চরিতার্থ হয়।

কা। খোদা নফরকে যেমন রাখিয়াছেন। এখন এই উমর, বাল সফেদ, কাজা পৌঁছিলেই হয়। দৌলতখানার কুশল সংবাদ ত?

সী। হুজুরের এক্া‍বালে গরিবখানার অমঙ্গলের সম্ভাবনা কি?

কা। এখন এখানে কি মনে করিয়া?

সী। এই গঙ্গারাম—বদ্ে‍বখতঅ—বেত্প‍মিজ যাই হোক, আমার স্বজাতি। তাই দুঃখে পড়িয়া হুজুরে হাজির হইয়াছি, জান বখ‍‍শিশ ফরমায়েশ করুন।

কা। সে কি? তাও কি হয়?

সীতা। মেহেরবান ও কদরদান সব পারে।

কা। খোদা মালেক। আমা হইতে এ বিষয়ের কিছু হইবে না।

সী। হাজার আসরফি জরমানা দিবে। জান বখ‍‍শিশ ফরমায়েশ করুন।

কাজি সাহেব ফকিরের মুখপানে চাহিলেন। ফকির ঘাড় নাড়িল। কাজি বলিলেন, “সে সব কিছু হইবে না। কবরমে কাফেরকো ডারো |”

সী। দুই হাজার আসরফি দিব। আমি জোড় হাত করিতেছি, গ্রহণ করুন। আমার খাতির!

কাজি ফকিরের মুখপানে চাহিল, ফকির নিষেধ করিল, সে কথাও উড়িয়া গেল। শেষ সীতারাম চারি হাজার আসরফি স্বীকার করিল। তাও না। পাঁচ হাজার-তাও না। আট হাজার-দশ হাজার, তাও না; সীতারামের আর নাই। শেষ সীতারাম জানু পাতিয়া করজোড়ে করিয়া অতি কাতরস্বরে বলিলেন, “আমার আর নাই। তবে, আর অন্য যা কিছু আছে, তাও দিতেছি। আমার তালুক মুলুক, জমি জেওরাত, বিষয়-আশয় সর্বস্ব দিতেছি। সব গ্রহণ করুন। উহাকে ছাড়িয়া দিন |”

কাজি সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও তোমার এমন কে যে, উহার জন্য সর্বস্ব দিতেছ?”

সীতা। ও আমার যেই হৌক, আমি উহার প্রাণদানে স্বীকৃত-আমি সর্বস্ব দিয়া উহার প্রাণ রাখিব। এই আমাদের হিন্দু ধর্ম।