ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সাগর শ্বশুরবাড়ী আসিয়া দুইটি ঘর পাইয়াছিল, একটি নীচে, একটি উপরে।

নীচের ঘরে বসিয়া সাগর পান সাজিত, সমবয়স্কাদিগের সঙ্গে খেলা করিত, কি গল্প করিত। উপরের ঘরে রাত্রে শুইত; দিনমানে নিদ্রা আসিলে সেই ঘরে গিয়া দ্বার দিত। অতএব ব্রজেশ্বর, ব্রহ্মঠাকুরাণীর উপকথার জ্বালা এড়াইয়া সেই উপরের ঘরে গেলেন।

সেখানে সাগর নাই–কিন্তু তাহার পরিবর্তে আর একজন কে আছে। অনুভবে বুঝিলেন, এই সেই প্রথমা স্ত্রী।

বড় গোল বাধিল। দুই জনে সম্বন্ধ বড় নিকট–স্ত্রী পুরুষ–পরস্পরের অর্ধাঙ্গ, পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। কিন্তু কখনও দেখা নাই। কি বলিয়া কথা আরম্ভ হইবে? কে আগে কথা কহিবে? বিশেষ একজন তাড়াইতে আসিয়াছে, আর একজন তাড়া খাইতে আসিয়াছে। আমরা প্রাচীনা পাঠিকাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, কথাটা কি রকমে আরম্ভ হওয়া উচিত ছিল?

উচিত যাই হউক–উচিতমত কিছুই হইল না। প্রথমে দুই জনের একজনও অনেকক্ষণ কথা কহিল না। শেষে প্রফুল্ল অল্প, অল্পমাত্র হাসিয়া, গলায় কাপড় দিয়া ব্রজেশ্বরের পায়ের গোড়ায় আসিয়া ঢিপ করিয়া এক প্রণাম করিল।

ব্রজেশ্বর বাপের মত নহে। প্রণাম গ্রহণ করিয়া অপ্রতিভ হইয়া বাহু ধরিয়া প্রফুল্লকে উঠাইয়া পালঙ্কে বসাইল। বসাইয়া আপনি কাছে বসিল।

প্রফুল্লের মুখে একটু ঘোমটা ছিল–সে কালের মেয়েরা এ কালের মেয়েদের মত নহে–ধিক এ কাল! তা সে ঘোমটাটুকু, প্রফুল্লকে ধরিয়া বসাইবার সময়ে সরিয়া গেল। ব্রজেশ্বর দেখিল যে, প্রফুল্ল কাঁদিতেছে। ব্রজেশ্বর না বুঝিয়া সুঝিয়া–আ ছি ! ছি! ছি! বাইশ বছর বয়সেই ধিক! ব্রজেশ্বর না বুঝিয়া সুঝিয়া, না ভাবিয়া চিন্তিয়া, যেখানে বড় ডব্ডমবে চোখের নীচে দিয়া এক ফোঁটা জল গড়াইয়া আসিতেছিল–সেই স্থানে–আ! ছি ! ছি !–ব্রজেশ্বর হঠাৎ চুম্বন করিলেন। গ্রন্থকার প্রাচীন–লিখিতে লজ্জা নাই–কিন্তু ভরসা করি, মার্জিতরুচি নবীন পাঠক এইখানে এ বই পড়া বন্ধ করিবেন।

যখন ব্রজেশ্বর এই ঘোরতর অশ্লীলতা-দোষে নিজে দূষিত হইতেছিলেন, এবং গ্রন্থকারকে সেই দোষে দূষিত করিবার কারণ হইতেছিলেন–যখন নির্বধ প্রফুল্ল মনে মনে ভাবিতেছিল যে, বুঝি এই মুখচুম্বনের মত পবিত্র পুণ্যময় কর্ম ইহজগতে কখনও কেহ করে নাই, সেই সময়ে দ্বারে কে মুখ বাড়াইল। মুখখানা বুঝি অল্প একটু হাসিয়াছিল–কি যার মুখ, তার হাতের গহনার বুঝি শব্দ হইয়াছিল–তাই ব্রজেশ্বরের কাণ সে দিকে গেল। ব্রজেশ্বর সে দিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, মুখখানা বড় সুন্দর। কালো কুচকুচে কোঁকড়ায় কোঁকড়াক ঝাপটায় বেড়া–তখন মেয়েরা ঝাপটা রাখিত–তার উপর একটু ঘোমটা টানা–ঘোমটার ভিতর দুইটা পদ্ম-পলাশ চক্ষু ও দুইখানা পাতলা রাঙ্গা ঠোঁট মিঠে মিঠে হাসিতেছে। ব্রজেশ্বর দেখিলেন, মুখখানা সাগরের। সাগর, স্বামীকে একটা চাবি ও কুলুপ দেখাইল। সাগর ছেলেমানুষ; স্বামীর সঙ্গে জিয়াদা কথা কয় না। ব্রজ কিছু বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু বুঝিতে বড় বিলম্বও হইল না। সাগর বাহির হইতে কপাট টানিয়া দিয়া, শিকল লাগাইয়া, কুলুপের চাবি ফিরাইয়া বন্ধ করিয়া দুড়্ দুড়্ করিয়া ছুটিয়া পলাইল। ব্রজেশ্বর, কুলুপ পড়িল শুনিতে পাইয়া, “কি কর সাগর! কি কর সাগর!” বলিয়া চেঁচাইল। সাগর কিছুতেই কাণ না দিয়া দুড়্ দুড়্ ঝম্ ঝম্ করিয়া ছুটিয়া একেবারে ব্রহ্মঠাকুরাণীর বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল।