দুর্গেশনন্দিনী
অভিরাম স্বামী চক্ষু মুছিয়া কহিলেন, “আপাতত: এইখানেই বাস!”
স্বামীর উত্তর শুনিতে না শুনিতেই রাজপুত্র প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। “আমাকে স্মরণ করিয়াছেন কি জন্য? রোদনই বা কেন?”
অভিরাম স্বামী কহিলেন, “যে কারণে রোদন করিতেছি, সেই কারণেই তোমাকে ডাকিয়াছি; তিলোত্তমার মৃত্যুকাল উপস্থিত |”
ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু, তিল তিল করিয়া, যোদ্ধৃপতি সেইখানে ভূতলে বসিয়া পড়িলেন। তখন আদ্যোপান্ত সকল কথা একে একে মনে পড়িতে লাগিল; একে একে অন্ত:করণ মধ্যে দারুণ তীক্ষ্ণ ছুরিকাঘাত হইতে লাগিল। দেবালয়ে প্রথম সন্দর্শন, শৈলেশ্বর-সাক্ষাৎ প্রতিজ্ঞা, কক্ষমধ্যে প্রথম পরিচয়ে উভয়ের প্রেমোত্থিত অশ্রুজল, সেই কাল-রাত্রির ঘটনা, তিলোত্তমার মূর্ছাবস্থার মুখ, যবনাগারে তিলোত্তমার পীড়ন, কারাগার মধ্যে নিজ নির্দয় ব্যবহার, পরে এক্ষণকার এই বনবাসে মৃত্যু, এই সকল একে একে রাজকুমারের হৃদয়ে আসিয়া ঝটিকা-প্রঘাতবৎ লাগিতে লাগিল। পূর্ব হুতাশন শতগুণ প্রচণ্ড জ্বালার সহিত জ্বলিয়া উঠিল।
রাজপুত্র অনেকক্ষণ মৌন হইয়া বসিয়া রহিলেন। অভিরাম স্বামী বলিতে লাগিলেন, “যে দিন বিমলা যবন-বধ করিয়া বৈধব্যের প্রতিশোধ করিয়াছিল, সেই দিন অবধি আমি কন্যা দৌহিত্রী লইয়া যবন-ভয়ে নানা স্থানে অজ্ঞাতে ভ্রমণ করিতেছিলাম, সেই দিন অবধি তিলোত্তমার রোগের সঞ্চার। যে কারণে রোগের সঞ্চার, তাহা তুমি বিশেষ অবগত আছ |”
জগৎসিংহের হৃদয়ে শেল বিঁধিল।
“সে অবধি তাহাকে নানা স্থানে রাখিয়া নানা চিকিৎসা করিয়াছি, নিজে যৌবনাবধি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছি, অনেক রোগের চিকিৎসা করিয়াছি; অন্যের অজ্ঞাত অনেক ঔষধ জানি। কিন্তু যে রোগ হৃদয়মধ্যে, চিকিৎসায় তাহার প্রতীকার নাই। এই স্থান অতি নির্জন বলিয়া ইহারই মধ্যে এক নিভৃত অংশে আজ পাঁচ সাত দিন বসতি করিতেছি। দৈবযোগে তুমি এখানে আসিয়াছ দেখিয়া তোমার অশ্ববল্গায় পত্র বাঁধিয়া দিয়াছিলাম। পূর্বাবধি অভিলাষ ছিল যে, তিলোত্তমাকে রক্ষা করিতে না পারিলে, তোমার সহিত আর একবার সাক্ষাৎ করাইয়া অন্তিম কালে তাহার অন্ত:করণকে তৃপ্ত করিব। সেইজন্যই তোমাকে আসিতে লিখিয়াছি। তখনও তিলোত্তমার আরোগ্যের ভরসা দূর হয় নাই; কিন্তু বুঝিয়াছিলাম যে, দুই দিন মধ্যে কিছু উপশম না হইলে চরম কাল উপস্থিত হইবে। এই জন্য দুই দিন পরে পত্র পড়িবার পরামর্শ দিয়াছিলাম। এক্ষণে যে ভয় করিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। তিলোত্তমার জীবনের কোন আশা নাই। জীবনদীপ নির্বাণোন্মুখ হইয়াছে।”
এই বলিয়া অভিরাম স্বামী পুনর্বার রোদন করিতে লাগিলেন। জগৎসিংহও রোদন করিতেছিলেন।
স্বামী পুনশ্চ কহিলেন, “অকস্মাৎ তোমার তিলোত্তমা সন্নিধানে যাওয়া হইবেক না; কি জানি, যদি এ অবস্থায় উল্লাসের আধিক্য সহ্য না হয়। আমি পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছি যে, তোমাকে আসিতে সংবাদ দিয়াছি, তোমার আসার সম্ভাবনা আছে। এই ক্ষণে আসার সংবাদ দিয়া আসি, পশ্চাৎ সাক্ষাৎ করিও |”
এই বলিয়া পরমহংস, যে দিকে ভগ্নাট্টালিকার অন্ত:পুর, সেই দিকে গমন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগমন করিয়া রাজপুত্রকে কহিলেন, “আইস |”
রাজপুত্র পরমহংসের সঙ্গে অন্ত:পুরাভিমুখে গমন করিলেন। দেখিলেন, একটি কক্ষ অভগ্ন আছে, তন্মধ্যে জীর্ণ ভগ্ন পালঙ্ক, তদুপরি ব্যাধিক্ষীণা, অথচ অনতিবিলুপ্তরূপরাশি তিলোত্তমা শয়নে রহিয়াছে; এ সময়েও পূর্বলাবণ্যের মৃদুলতর-প্রভাবপরিবেষ্টিত রহিয়াছে; -নির্বাণোন্মুখ প্রভাততারার ন্যায় মনোমোহিনী হইয়া রহিয়াছে। নিকটে একটি বিধবা বসিয়া অঙ্গে হস্তমার্জন করিতেছে; সে নিরাভরণা, মলিনা, দীনা বিমলা। রাজকুমার তাহাকে প্রথমে চিনিতে পারিলেন না, কিসেই বা চিনিবে, যে স্থিরযৌবনা ছিল, সে এক্ষণে প্রাচীনা হইয়াছে।
যখন রাজপুত্র আসিয়া তিলোত্তমার শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইলেন, তখন তিলোত্তমা নয়ন মুদ্রিত করিয়া ছিলেন। অভিরাম স্বামী ডাকিয়া কহিলেন, “তিলোত্তমে! রাজকুমার জগৎসিংহ আসিয়াছেন |”
তিলোত্তমা নয়ন উন্মীলিত করিয়া জগৎসিংহের প্রতি চাহিলেন; সে দৃষ্টি কোমল, কেবল স্নেহব্যঞ্জক; তিরস্কারণাভিলাষের চিহ্নমাত্র বর্জিত। তিলোত্তমা চাহিবামাত্র দৃষ্টি বিনত করিলেন; দেখিতে দেখিতে লোচনে দর দর ধারা বহিতে লাগিল। রাজকুমার আর থাকিতে পারিলেন না; লজ্জা দূরে গেল; তিলোত্তমার পদপ্রান্তে বসিয়া নীরবে নয়নাসারে তাঁহার দেহলতা সিক্ত করিলেন।