দুর্গেশনন্দিনী
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : অঙ্গুরীয় প্রদর্শন
বিমলা গমন করিলে পর, একাকিনী কক্ষমধ্যে বসিয়া তিলোত্তমা যে সকল চিন্তা করিতে ছিলেন, তাহা সুখদু:খ উভয়েরই কারণ। পাপাত্মার পিঞ্জর হইতে যে আশু মুক্তি পাইবার সম্ভাবনা হইয়াছে, এ কথা মুহুর্মুহু: মনে পড়িতে লাগিল; কিন্তু কেবল এই কথাই নহে, বিমলা যে তাঁহাকে প্রাণাধিক স্নেহ করেন, বিমলা হইতেই যে তাঁহার উদ্ধার হইবার উপায় হইল, ইহা পুন: পুন: মনোমধ্যে আন্দোলন করিয়া দ্বিগুণ সুখী হইতে লাগিলেন। আবার ভাবিতে লাগিলেন, “মুক্ত হইলেই বা কোথা যাইব? আর কি পিতৃগৃহ আছে?” তিলোত্তমা আবার কাঁদিতে লাগিলেন। সকল চিন্তার সমতা করিয়া আর এই চিন্তা মনোমধ্যে প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। “রাজকুমার তবে কুশলে আছেন? কোথায় আছেন? কি ভাবে আছেন? তিনি কি বন্দী?” এই ভাবিতে ভাবিতে তিলোত্তমা বাষ্পাকুললোচনা হইতে লাগিলেন। “হা অদৃষ্ট! রাজপুত্র আমারই জন্য বন্দী। তাঁহার চরণে প্রাণ দিলেও কি ইহার শোধ হইবে? আমি তাঁহার জন্য কি করিব?” আবার ভাবিতে লাগিলেন, “তিনি কি কারাগারে আছেন? কেমন সে কারাগার? সেখানে কি আর কেহই যাইতে পারে না? তিনি কারাগারে বসিয়া কি ভাবিতেছেন? তিলোত্তমা কি তাঁহার মনে পড়িতেছে? পড়িতেছে বই কি? আমিই যে তাঁহার এ যন্ত্রণার মূল! না জানি, মনে মনে আমাকে কত কটু বলিতেছেন!” আবার ভাবিতেছেন, “সে কি?” আমি এ কথা কেন ভাবি! তিনি কি কাহাকে কটু বলেন? তা নয়, তবে এই আশঙ্কা, যদি আমাকে ভুলিয়া গিয়া থাকেন, কি যদি আমি যবনগৃহবাসিনী হইয়াছি বলিয়া ঘৃণায় আমাকে আর মনোমধ্যে স্থান না দেন |” আবার ভাবেন, “না না– তা কেন করিবেন; তিনিও যেমন দুর্গমধ্যে বন্দী, আমিও তেমনিই বন্দীমাত্র; তবে কেন ঘৃণা করিবেন? তবু যদি করেন, তবে আমি তাঁর পায়ে ধরিয়া বুঝাইব। বুঝিবেন না? বুঝিবেন বই কি। না বুঝেন, তাঁহার সম্মুখে প্রাণত্যাগ করিব। আগে আগুনে পরীক্ষা হইত; কলিতে তাহা হয় না; না হউক, আমি না হয় তাঁহার সম্মুখে আগুনে প্রাণত্যাগই করিব!” আবার ভাবেন, “কবেই বা তাঁহার দেখা পাইব? কেমন করিয়া তিনি মুক্ত হইবেন? আমি মুক্ত হইলে কি কার্য সিদ্ধ হইল? এ অঙ্গুরীয় বিমাতা কোথা পাইলেন? তাঁহার মুক্তির জন্য এ কৌশল হয় না? এ অঙ্গুরীয় তাঁহার নিকট পাঠাইলে হয় না? কে আমাকে লইতে আসিবে? তাহার দ্বারা কি কোন উপায় হইতে পারিবে না? ভাল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব, কি বলে। একবার সাক্ষাৎও কি পাইতে পারিব না?” আবার ভাবেন, “কেমন করিয়াই বা সাক্ষাৎ করিতে চাহিব? সাক্ষাৎ হইলেই বা কি বলিয়াই কথা কহিব? কি কথা বলিয়াই বা মনের জ্বালা জুড়াইব?”
তিলোত্তমা অবিরত চিন্তা করিতে লাগিলেন।
একজন পরিচারিকা গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। তিলোত্তমা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাত্রি কত?”
দাসী কহিল, “দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইয়াছে |” তিলোত্তমা দাসীর বহির্গমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। দাসী প্রয়োজন সমাপন করিয়া চলিয়া গেল, তিলোত্তমা বিমলা-প্রদত্ত অঙ্গুরীয় লইয়া কক্ষমধ্যে হইতে যাত্রা করিলেন। তখন আবার মনে আশঙ্কা হইতে লাগিল। পা কাঁপে, হৃদয় কাঁপে, মুখ শুকায়; একপদে অগ্রসর একপদে পশ্চাৎ হইতে লাগিলেন। ক্রমে সাহসে ভর করিয়া অন্ত:পুরদ্বার পর্যন্ত গেলেন। পৌরবর্গ খোজা হাব্সীা প্রভৃতি সকলেই প্রমোদে ব্যস্ত; কেহ তাঁহাকে দেখিল না; দেখিলেও তৎপ্রতি মনোযোগ করিল না; কিন্তু তিলোত্তমার বোধ হইতে লাগিল যেন সকলেই তাঁহাকে লক্ষ্য করিতেছে। কোনক্রমে অন্ত:পুরদ্বার পর্যন্ত আসিলেন; তথায় প্রহরিগণ আনন্দে উন্মত্ত। কেহ নিদ্রিত, কেহ জাগ্রতে অচেতন, কেহ অর্ধচেতন। কেহ তাঁহাকে লক্ষ্য করিল না। একজন মাত্র দ্বারে দণ্ডায়মান ছিল; সেও প্রহরীর বেশধারী। সে তিলোত্তমাকে দেখিয়া কহিল, “আপনার হাতে আঙ্গটি আছে?”
তিলোত্তমা সভয়ে বিমলাদত্ত অঙ্গুরীয় দেখাইলেন। প্রহরিবেশী উত্তমরূপে সেই অঙ্গুরীয় নিরীক্ষণ করিয়া নিজ হস্তস্থ অঙ্গুরীয় তিলোত্তমাকে দেখাইল। পরে কহিল, “আমার সঙ্গে আসুন, কোন চিন্তা নাই |”