একাদশ পরিচ্ছেদ : গৃহান্তর

অপরাহ্নে কথামত ওসমান রাজপুত্র সমক্ষে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “যুবরাজ! প্রত্যুত্তর পাঠাইবার অভিপ্রায় হইয়াছে কি?”

যুবরাজ প্রত্যুত্তর লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, পত্র হস্তে লইয়া ওসমানকে দিলেন। ওসমান লিপি হস্তে লইয়া কহিলেন, “আপনি অপরাধ লইবেন না; আমাদের পদ্ধতি আছে, দুর্গবাসী কেহ কাহাকে পত্র প্রেরণ করিলে, দুর্গ-রক্ষকেরা পত্র পাঠ না করিয়া পাঠান না |”

যুবরাজ কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ হইয়া কহিলেন, “এ ত বলা বাহুল্য। আপনি পত্র খুলিয়া পড়ুন; অভিপ্রায় হয়, পাঠাইয়া দিবেন।”

ওসমান পত্র খুলিয়া পাঠ করিলেন। তাহাতে এই মাত্র লেখা ছিল–

“মন্দভাগিনি! আমি তোমার অনুরোধ বিস্মৃত হইব না। কিন্তু তুমি যদি পতিব্রতা হও, তবে শীঘ্র পতিপথাবলম্বন করিয়া আত্মকলঙ্ক লোপ করিবে।

জগৎসিংহ |”

ওসমান পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র! আপনার হৃদয় অতি কঠিন |”

রাজপুত্র নীরস হইয়া কহিলেন, “পাঠান অপেক্ষা নহে |”

ওসমানের মুখ একটু আরক্ত হইল। কিঞ্চিৎ কর্কশ ভঙ্গিতে কহিলেন, “বোধ করি, পাঠান সর্বনাশে আপনার সহিত অভদ্রতা না করিয়া থাকিবে |”

রাজপুত্র কুপিতও হইলেন, লজ্জিতও হইলেন। এবং কহিলেন, “না মহাশয়! আমি নিজের কথা কহিতেছি না। আপনি আমার প্রতি সর্বাংশে দয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এবং বন্দী হইয়াও প্রাণদান দিয়াছেন; সেনা-হন্তা শত্রুর সাংঘাতিক পীড়ার শমতা করাইয়াছেন;- যে ব্যক্তি কারাবাসে শৃঙ্খলবদ্ধ থাকিবে, তাহাকে প্রমোদাগারে জড়িত হইতেছি; এ সুখের পরিণাম কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। আমি বন্দী হই, আমাকে কারাগারে স্থান দিন, এ দয়ার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করুন। আর যদি বন্দী না হই, তবে আমাকে এ হেমপিঞ্জরে আবদ্ধ রাখার প্রয়োজন কি?”

ওসমান স্থিরচিত্তে উত্তর করিলেন, “রাজপুত্র! অশুভের জন্য ব্যস্ত কেন? অমঙ্গলকে ডাকিতে হয় না, আপনিই আইসে |”

রাজপুত্র গর্বিত বচনে কহিলেন, “আপনার এ কুসুমশয্যা ছাড়িয়া কারাগারের শিলাশয্যায় শয়ন করা রাজপুতেরা অমঙ্গল বলিয়া গণে না |”

ওসমান কহিলেন, “শিলাশয্যা যদি অমঙ্গলের চরম হইত, তবে ক্ষতি কি?”

রাজপুত্র ওসমান প্রতি তীব্র দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “যদি কতলু খাঁকে সমুচিত দণ্ড দিতে না পারিলাম, তবে মরণেই বা ক্ষতি কি?”

ওসমান কহিলেন, “যুবরাজ! সাবধান! পাঠানের যে কথা সেই কাজ!”

রাজপুত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “সেনাপতি, আপনি যদি আমাকে ভয় প্রদর্শন করিতে আসিয়া থাকেন, তবে যত্ন বিফল জ্ঞান করুন |”

ওসমান কহিলেন, “রাজপুত্র, আমরা পরস্পর সন্নিধানে এরূপ পরিচিত আছি যে, মিথ্যা বাগাড়ম্বর কাহারও উদ্দেশ্য হইতে পারে না। আমি আপনার নিকট বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য আসিয়াছি।”

জগৎসিংহ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন। কহিলেন, “অনুমতি করুন |”