দুর্গেশনন্দিনী
রাজপুত্র কহিলেন, “সে কি?” গজপতি কহিলেন, “যখন মোছলমান বাবুরা গড়ে এলেন, তখন আমাকে কহিলেন যে, আয় বামন তোর জাতি মারিব। এই বলিয়া তাঁহারা আমাকে ধরিয়া লইয়া মুরগির পালো রাঁধিয়া খাওয়াইলেন |”
“পালো কি?”
দিগ্গমজ কহিলেন, “আতপ চাউল ঘৃতের পাক |”
রাজপুত্র বুঝিলেন পদার্থটা কি। কহিলেন, “বলিয়া যাও!”
“তারপর আমাকে বলিলেন, ‘তুই মোছলমান হইয়াছিস’; সেই অবধি আমি মোছলমান |”
রাজপুত্র এই অবসরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর আর সকলের কি হইয়াছে?”
“আর আর ব্রাহ্মণ অনেকেই ঐরূপ মোছলমান হইয়াছে |”
রাজপুত্র ওসমানের মুখপানে দৃষ্টি করিলেন। ওসমান রাজপুত্রকৃত নির্বাক তিরস্কার বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র, ইহাতে দোষ কি? মোছলমানের বিবেচনায় মহম্মদীয় ধর্মই সত্য ধর্ম; বলে হউক, ছলে হউক, সত্যধর্মপ্রচারে আমাদের মতে অধর্ম নাই, ধর্ম আছে |”
রাজপুত্র উত্তর না করিয়া বিদ্যাদিগ্গ জকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, “বিদ্যাদিগ্গ জ মহাশয়!”
“আজ্ঞা এখন সেখ দিগ্গ্জ |”
“আচ্ছা তাই; সেখজী, গড়ের আর কাহারও সংবাদ আপনি জানেন না?”
ওসমান রাজপুত্রের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া উদ্বিগ্ন হইলেন। দিগ্গগজ কহিলেন, “আর অভিরাম স্বামী পলায়ন করিয়াছেন |”
রাজপুত্র বুঝিলেন, নির্বোধকে স্পষ্ট স্পষ্ট জিজ্ঞাসা না করিলে কিছুই শুনিতে পাইবেন না। কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহের কি হইয়াছে?”
ব্রাহ্মণ কহিলেন, “নবাব কতলু খাঁ তাঁহাকে কাটিয়া ফেলিয়াছেন!”
রাজপুত্রের মুখ রক্তিমবর্ণ হইল। ওসমানকে জিজ্ঞাসা কহিলেন, “সে কি? এ ব্রাহ্মণ অলীক কথা কহিতেছে?”
ওসমান গম্ভীরভাবে কহিলেন, “নবাব বিচার করিয়া রাজবিদ্রোহী জ্ঞানে প্রাণদণ্ড করিয়াছেন |”
রাজপুত্রের চক্ষুতে প্রোজ্জ্বল হইল।
ওসমানকে জিজ্ঞাসিলেন, “আর একটা নিবেদন করিতে পারি কি? কার্য কি আপনার অভিমতে হইয়াছে?”
ওসমান কহিলেন, “আমার পরামর্শের বিরুদ্ধে |”
রাজপুত্র বহুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। ওসমান সুসময় পাইয়া দিগ্গজজকে কহিলেন, “তুমি এখন বিদায় হইতে পার |”
দিগ্গতজ গাত্রোত্থান করিয়া চলিয়া যায়, কুমার তাঁহার হস্তধারণপূর্বক নিবারণ করিয়া কহিলেন, “আর এক কথা জিজ্ঞাসা; বিমলা কোথায়?”
ব্রাহ্মণ নিশ্বাস ত্যাগ করিল, একটু রোদনও করিল। কহিল, “বিমলা এখন নবাবের উপপত্নী |”
রাজকুমার বিদ্যুদ্দৃষ্টিতে ওসমানের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, “এও সত্য?”
ওসমান কোন উত্তর না করিয়া ব্রাহ্মণকে কহিলেন, “তুমি আর কি করিতেছ? চলিয়া যাও |”
রাজপুত্র ব্রাহ্মণের হস্ত দৃঢ়তর ধারণ করিলেন, যাইবার শক্তি নাই। কহিলেন, “আর এক মুহূর্ত রহ; আর একটি কথা মাত্র।” তাঁহার আরক্ত লোচন হইতে দ্বিগুণতর অগ্নি বিস্ফুরণ হইতেছিল, “আর একটা কথা। তিলোত্তমা?”
ব্রাহ্মণ উত্তর করিল, “তিলোত্তমা নবাবের উপপত্নী হইয়াছে। দাসদাসী লইয়া তাহারা স্বচ্ছন্দে আছে |”
রাজকুমার বেগে ব্রাহ্মণের হস্ত নিক্ষেপ করিলেন, ব্রাহ্মণ পড়িতে পড়িতে রহিল।
ওসমান লজ্জিত হইয়া মৃদুভাবে কহিলেন, “আমি সেনাপতি মাত্র |”
রাজপুত্র উত্তর করিলেন, “আপনি পিশাচের সেনাপতি |”